দুদিন ধরে মনে হচ্ছে প্যারিসের
প্রকৃতিতে যেন বাংলাদেশের মতো আষাঢ়-শ্রাবণের ছোঁয়া লেগেছে। কখনো ঘনবর্ষণ আরার কখনো গুঁড়ি
গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেহ-মনে এক অন্য রকম আচ্ছাদন এনে দিচ্ছে। যখন বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে ঘুম
ভাঙল, তখন মনে হচ্ছিল আমি বাংলার কোনো
অজপাড়াগাঁয়ের শণবন ও বাঁশের তৈরি কোনো কুঁড়েঘরে শুয়ে আছি বর্ষণমুখর এক
প্রভাতবেলায়।বৃষ্টির কারণে ঠান্ডার প্রকোপটাও বেড়ে গিয়েছে। তাই অলস দেহটা বারবার গৃহমুখী
হতে চাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আজ
গৃহবন্দী হয়ে স্মৃতিচারণা করব, প্যারিসের প্রকৃতি থেকে একচিলতে বাংলার বর্ষার স্বাদ নেব। প্যারিসে বৃষ্টি হলে এখানের
রাস্তাঘাট অনেকটাই জনমানবশূন্য হয়ে যায়। ক্যাফে বারগুলোর আড্ডা তেমন জমে ওঠে
না। বৃষ্টির প্রকৃতিতে অধিকাংশ
ফরাসির মন বিষণ্নতায় ছেয়ে ফেলে। ফরাসি সাহিত্যেও বৃষ্টির প্রকৃতিকে তেমন ফুটিয়ে তোলা হয়নি। কারণ, এই বৃষ্টি ফরাসি জনগোষ্ঠীর কাছে
অপন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।অপর দিকে বাংলার প্রকৃতিতে বৃষ্টি এক অপরূপ নান্দনিকতার নাম। তাই তো রবীন্দ্র, নজরুল এবং অন্যান্য কবির
কাব্য-গানে বর্ষা ও বৃষ্টির প্রকৃতিকে নানা রং ও ঢঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এই অপরূপ নৈসর্গিক প্রকৃতির
মধ্য দিয়ে আমার শৈশব, কৈশোর
ও যৌবনের অমিয় সুধা পান করা। তাই তো এই সুদূর প্রবাসে বসেও বৃষ্টি দেখলে আমি ফিরে যাই সেই
ছেলেবেলার বর্ষার নদীর পাড় ধরে দৌড়ে একঝাঁক বালকের ন্যাংটা হয়ে ঝাঁপ দিয়ে
ডুবসাঁতার খেলার দলে, বৃষ্টিভেজা
ফুটবল খেলার মাঠে, হারিয়ে
যাই পড়ার টেবিলের সামনে জানালা খুলে ফুল বাগানের ফোটা ফুলগুলোর বাতাস বৃষ্টি
সংমিশ্রিত দোল খাওয়ার রোমাঞ্চিত দৃশ্যে। এ যেন না পাওয়ার মাঝে হাতড়ে কিছু
খুঁজে পাওয়ার সান্ত্বনা।২৫ আগস্ট রোববার। ছুটির দিন। বিছানায় শুয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। কিন্তু সে স্বাদ আজ আর বেশি
নেওয়া হলো না। প্যারিসের কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের বন্ধু মিলে সেদিন আয়োজন করেছিল
এক ব্যতিক্রমী ভ্রমণ কর্মসূচি। পরিদর্শন স্থান ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন কর্তৃক নির্মিত জরদা
দো এক্লিমেসিও উদ্যান। তাই পরিদর্শক দলের একজন হিসেবে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এবং সব
স্মৃতিরোমন্থিত সুখানুভূতির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম জরদা দো
এক্লিমেসিও পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে। ১৮৬০ সালের ৬ অক্টোবর ভ্রমণার্থীদের জন্য এই উদ্যানটি খুলে
দেওয়া হয় এবং এটিই প্যারিসের সবচেয়ে পুরোনো উদ্যান। প্রায় দুই মিলিয়ন ভ্রমণার্থী
পরিদর্শিত উদ্যানটিতে প্রবেশের পর চোখে পড়ল ময়ূরের অবাধ বিচরণ। হরিণের দ্বিধাহীন মুক্ত চলাচল। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ
থেকে সংগৃহীত বিশেষায়িত গৃহপালিত পশুর খামার; উট, গরু, ছাগল, গাধা ইত্যাদি আমাদের পরিদর্শক
দলের সবাইকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। সেই সঙ্গে বয়ে চলা লেকের স্বচ্ছ জলে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ
যেন এক বাড়তি মুগ্ধতা এনে দেয়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির বর্ষণ নিঃশেষ হয়ে গেল এবং
আমরা অবস্থান নিলাম উদ্যানের ভেতরে অবস্থিত একটি ক্যাফে বারে। সবাই এই ভ্রমণের উচ্ছ্বাস
ব্যক্ত করল নিজস্ব অনুভূতি থেকে। সিদ্ধান্ত হলো, এই সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক বন্ধুরা কর্মক্লান্ত দেহ-মনকে
উজ্জীবিত করার জন্য প্রতি মাসে একদিন এভাবেই বেছে নেবে ঐতিহাসিক কিংবা বিশেষ কোনো
স্থান এবং ভ্রমণের বর্ণনা ও ছবি প্রকাশ করা হবে বিশেষ একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে।
প্যারিসে বাংলার বর্ষার স্বাদ, প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো ০৭.০৯.২০১৩
প্যারিসে বাংলার বর্ষার স্বাদ, প্রকাশ: দৈনিক ইপ্রথম আলো ০৭.০৯.২০১৩
উল্লেখ্য, এই আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ফ্রান্স উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান এবং সঞ্চালকের বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন ফরাসি বংশোদ্ভূত একজন বাঙালি বধূ।
প্যারিসে বাংলার বর্ষার স্বাদ, প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো ০৭.০৯.২০১৩
প্যারিসে বাংলার বর্ষার স্বাদ, প্রকাশ: দৈনিক ইপ্রথম আলো ০৭.০৯.২০১৩