১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে
সালাম,
বরকত, রফিক, জব্বার,
শফিক নামে রাজপথের কয়েকটি প্রজ্জলিত শিখাকে তৎকালীন পাকিস্থান সরকার নিভিয়ে
দিয়েছিলো।সেই নিভে যাওয়া
প্রদীপ শিখাদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে আজ প্রাণ
ভরে মায়ের ভাষায় কথা বলি,কবিতা লিখি,গল্প
লিখি, ব্লগিং করি,গর্ব করে বলি আমি
বাঙ্গালী, আমার ভাষা বাংলা, অ আ ই
ঈ এ আমার নিজস্ব স্বরলিপি কারো কাছ থেকে ধার করা নয়।২০১০ সালের একই দিনে সেইসব মহান ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা
নিবেদন কর্মসূচি পালন করে দিন শেষে রাজবাড়ী থেকে কর্মস্থল ঢাকায় ফেরার পথে ঢাকা মানিকগঞ্জ
মহাসড়কে সড়ক দূর্ঘটনায় বাংলার বুক থেকে নিভে যায় ‘ফরিদুল ইসলাম ফরিদ’
নামে আর একটি প্রদীপ শিখা।
আত্মকেন্দ্রিক,সুবিধাবাদী ও ভোগবাদী
সমাজ ব্যবস্থার মাঝে কিছু মানুষ জন্ম নেয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের
সমগ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন এবং সমাজবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে গণ-মানুষের মুক্তির পথ দেখানোর মানুসিকতা নিয়ে। রাজবাড়ী সরকারী কলেজের সাবেক ভি পি এবং বাংলাদেশ
ছাত্রমৈত্রী রাজবাড়ী জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ‘ফরিদুল ইসলাম ফরিদ ছিলেন তেমনি একজন মানব মুক্তির স্বপ্নদেখা ক্ষণজন্মা
সুপুরুষ।
জীবনের এই ক্ষণকালের মধ্যেই রাজবাড়ী'র মানুষের নিকট ফরিদুল
ইসলাম ফরিদের আবির্ভাব হয়েছিলো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আশাজাগানিয়া এবং তরুন সমাজের
অনুসরণীয় প্রিয় মানুষরূপে।আর রাজনৈতিক অঙ্গনে আত্নপ্রকাশ ঘটেছিলো বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-রূপে।তার এই স্বাতন্ত্র
ব্যক্তিত্ব সত্তার অধিকারী হয়ে ওঠার মূলে ছিলো শ্রেনী বৈষম্য সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের অপরিবর্তনীয় ভাগ্য কাছ থেকে উপলব্ধির
সুযোগ, শ্রমজীবী সংগ্রামী মানুষের অধিকার আদায়ের একটি শক্ত
সাংগঠনিক রাজনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ছিলো তার বেড়ে ওঠা, এবং এর
মধ্যদিয়ে সমাজ পরিবর্তনের এক প্রতিবাদী মানুসিকতার মানুষ হিসেবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা। শিক্ষিত সমাজের রুচিবান মানুষদের আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গী দ্বারা মুগ্ধ করার কৌশল যেমন তার আয়ত্ব ছিলো, ঠিক তেমনি শিক্ষার আলো নাফোটা সাধারণ মানুষের সাথে আপন করে মিশে যাওয়ার ভাষায়ও ছিলেন সমান বাকপটু। মঞ্চে ছিলেন রাষ্ট্রের সমসাময়িক সমস্যার বিশ্লেষন ও করণীয় বিষয়ের উপর একজন শৈল্পিক সুবক্তা। রাজপথে ছাত্রদের অধিকার ও দাবী আদায়ে ছিলেন সম্মোহনী শক্তির অধিকারী একজন সুসংগঠক।
একজন ছাত্রনেতার টেন্ডারবাজী,চাঁদাবাজীর পরিবর্তে, শিক্ষা অর্জনের ভেতর দিয়ে সুশিক্ষিত সৎ এবং সমাজ সচেতন মানুষ হয়ে রাষ্ট্রের সেবা করাই মূল লক্ষ্য, আর এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজ সংগঠনের ছাত্রনেতা ও কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস।
আজও দলমত নির্বিশেষে রাজবাড়ীর অনেক তরুনের নিকট তিনি প্রিয়নেতা।তার এই অকাল প্রয়ান আজও রাজবাড়ী বাসীর মেনে নিতে কষ্টে নীল হতে হয়।সবার মত, তিনি ছিলেন আমারও একজন প্রিয় মানুষ এবং প্রিয় ছাত্রনেতা। বড় ভাইতুল্য মানুষ ,তাই ডাকতাম ফরিদ ভাই বলে।ছাত্র অবস্থায় আমি বলার মত ছাত্রনেতা ছিলাম না কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর একজন কর্মী হওয়ার সুবাদে ফরিদ ভাইয়ের সাথে রয়ে গেছে কিছু নিবিড় স্মৃতি।তার একান্ত কিছু স্বপ্ন,ইচ্ছা ও সমাজ ভাবনার চিন্তা জমা পরে আছে আমার স্মৃতির ফিতায়।
আমার বেড়ে ওঠা এক শ্রমজীবী শ্রেণীর আন্দোলন সংগ্রামের সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ী জেলা সদরে।এই অঞ্চলের মানুষের এক সময় মধ্যরাতের ঘুম ভেঙ্গে যেতো মিছিলের গর্জনের আওয়াজে।সবার মধ্যে মার্কস ,লেলিন কিংবা মাওসেতুংয়ের সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকলেও এ অঞ্চলের মানুষ ঐতিহ্যগত ভাবে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থক।তাই স্বভাবতই না বুঝেই ছোট বেলা থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে সমাজতন্ত্রের একজন সমর্থক ছিলাম।মার্কসবাদ লেলিনবাদ সর্বহারার মতবাদ ,লড়াই লড়াই লড়াই চাই , লড়াই করে বাঁচতে চাই ,এই লড়াইয়ে জিতবে জিতবে কারা, কৃষক শ্রমিক সর্বহারা ,কমরেড খাইরু ভাই, লও লও লও সালাম ,এই শ্লোগানগুলো প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতি না করেই সেই ন্যাংটো বেলাতেই ছেলেবেলার ছড়া শেখার মত মুখস্থ হয়েগিয়েছিলো।স্কুল জীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুদের অনেকই ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও আমার হয়ে ওঠেনি পারিবারিক বিধিনিষেদের কারণে।আমি ঝুকে পরলাম পড়ালেখার পাশাপাশী সংবাদপত্রে লেখালেখির দিকে।
১৯৯৮ সালে রাজবাড়ী সরকারী কলেজে যখন দ্বাদশ শ্রেনীতে পড়ি, তখন বন্ধু রিমন রহমান একদিন সাথে করে রাজবাড়ী কন্ঠ পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়ে পত্রিকার সম্পাদক জহুরুল ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন ,আমার বন্ধু আপনার পত্রিকায় কাজ করতে আগ্রহী।সেই থেকে কলেজের নানা অনুষ্ঠান,ছাত্র রাজনীতি,শিক্ষক সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ের উপর সংবাদ লেখার মধ্যদিয়ে রাজবাড়ী কন্ঠ পত্রিকায় মফস্বল সাংবাদিকতার শুরু।সেই সময় ফরিদ ভাই রাজবাড়ী সরকারী
কলেজের জনপ্রিয় ছাত্র নেতা এবং ছাত্র সংসদের ভি পি। তাছাড়া তাঁর পোষাকের রুচিশীলতা,হেয়ার স্টাইল,বক্তৃতা ও কথা বলার নান্দনিক ভঙ্গী ইত্যাদি কারনে তিনি ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিকট মডেল স্বরূপ।
১৯৯৯ সাল,ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা বের করার সিদ্ধান্ত হলো।সম্পাদক জহুরুল ভাই আমাকে ডেকে বললো,রাজবাড়ীর জনপ্রিয় শিল্পী,ছাত্রনেতা,শ্রমজীবি মানুষ, এই শ্রেনীর মানুষদের মধ্য থেকে ঈদ ভাবনা নিয়ে একটি করে সাক্ষাৎকার যোগার কর।ঈদ
নিয়ে তারা কি ভাবে ?দায়িত্ব দিলেন এই পাতাটি আমাকে সাজাতে ।আর পরামর্শ দিলেন, ছাত্রনেতার সাক্ষাৎকারটি ভিপি ফরিদুল ইসলামের কাছ থেকে নিতে।এসাইনমেন্ট অনুযায়ী একদিন সকালে ফরিদ ভাইয়ের বাসায় গেলাম।ওনাকে ওনার ঈদ নিয়ে একান্ত ভাবনা নিয়ে একটা লেখা দিতে বললাম।উনি রাজি হলেন এবং চার পাঁচ দিন পরে এসে নিয়ে যেতে বললেন।পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ওনার ঈদ ভাবনার লেখাটি ছাপা হলো।আমি ওনাকে একটি সৌজন্য সংখ্যা বাসায় গিয়ে দিয়ে আসলাম।উনি খুব খুশী হলেন।ওনার সেই ঈদ ভাবনার লেখাটুকু হুবহু তুলে ধরছি…..
« ঈদ নিয়ে ভাবনাতো একটা আছেই।আমি আমার মত করে ভাবছি।তেমন চাওয়া নেই পাওয়াও নেই।হবে অন্যরকম,তবে আমাকে নিয়ে তেমন ভাবী না।ভাবী ওদের নিয়ে,ওরা যে ভাবনায় ফেলে দেয়।সেই ছোট বেলা,যখন ঈদ এলে এটা ওটা কেনা নিয়ে চিৎকার করতাম।সেটা আর নেই,ঈদের দিন খুব সেজেগুজে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম,দেখতাম উলঙ্গ শিশু তার মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে,মা চিৎকার করে কাঁদছে বাবা একটা পয়সা দাও , একটা পয়সা দাও বাবা।ছোট ছোট শিশুরা ফেলে দেওয়া আইসক্রীমের লাঠি চুষে খাচ্ছে,কেউবা উড়ন্ত বেলুনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।এখানেই শেষ নয়,বিকেলে যখন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরুতাম দেখতাম কাগজের লাল টুপি পড়ে কিশোর ছেলে রিক্সা চালাচ্ছে।এধরনের হাজার সমস্যা ভাবনায় ফেলে দেয়।আজকের এই সমাজব্যবস্থা যে ঈদের আনন্দটুকু ঢেকে ফেলে।সমাজে যেদিন উচু নিচুর ভেদাভেদ থাকবে না।সেদিন হয়তো নিজের মতো করে ভাবা যাবে।সবাই ঈদের আনন্দ উপভোগ করুক,এটাই আমার বড় ভাবনা »
২০০১ সাল ,ওয়ার্কাস পার্টি রাজবাড়ী জেলা শাখার টাল মাটাল অবস্থা।দীর্ঘ দিনের একচ্ছত্র আধিপত্য পাহাড় ধসের মত ভেঙ্গে পড়েছে।দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র মৈত্রী’র সাংগঠনিক অবস্থা আরো বেশী খারাপ।যে কলেজর ছাত্র সংসদে ছাত্রমৈত্রী’র
প্যানেল থেকে আটজন ভিপি নির্বাচিত হয়েছে,সেই ছাত্র সংগঠনের কলেজ ক্যাম্পাসে কর্মীর অভাবে একটি মিছিল বের করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।দলের এই করুন অবস্থা তৈরী হওয়ার মূলে ছিলো,তৎকালিন ওয়ার্কাস পার্টি রাজবাড়ী জেলা শাখার অন্যতম নেতা,দলের প্রাণ-ভ্রমর,দলীয় মনোনয়নে রাজবাড়ী পৌরসভার তিন তিনবারের নির্বাচিত মেয়র আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম এর রাজনৈতিক চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়ে বি এন পি’তে যোগদানের ফলে।সেই সময়ের রাজবাড়ী জেলা ওয়ার্কাস পার্টি অনেকটাই খৈয়ম নির্ভর পার্টি ছিলো। টানা দশ বছর পৌরসভার চেয়ার নিজ দখলে থাকা, প্রয়াত কমরেড আল্লা নেওয়াজ খাইরু’র ছোট ভাই হওয়াতে পারিবারিক ইমেজ এবং রাজনৈতিক কৌশলে চাতুর্য গুনের অধিকারী হওয়ায় দলের মধ্যে বিশাল একটি অংশ তার অন্ধ অনুসারী হয়ে ওঠে এবং তিনি রাজবাড়ী জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভাব হন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরূপে।তখন রাজবাড়ী জেলার সার্বিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সর্বদলীয় কোন আন্দোলন সংগ্রাম হলে সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে জেলার দুই সংসদ সদস্যের থেকে তাকে বেশী গুরত্ব দেওয়া হতো।সেই সময় সর্বদলীয় রেল রক্ষা ও পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়কও ছিলেন আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম।
দলের থেকে যখন কোন ব্যক্তি বেশি গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন দলের জন্য এক অনিবার্য ভয়াবহ সংকট অপেক্ষা করে।রাজবাড়ী জেলা ওয়ার্কাস পার্টির ক্ষেত্রেও তার একবিন্দু ব্যতিক্রম ঘটেনি।আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের দল ত্যাগের সময় তার অন্ধ অনুসারীরাও তার সঙ্গে বি এন পি’তে চলে যায়।এর পর তিনি যখন বি এন পি’র মনোনয়ন লাভ করে রাজবাড়ী ১ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তখন ওয়ার্কাস পার্টি এবং ছাত্র মৈত্রীর ত্যাগী নেতা কর্মীদের আর একটি বিশাল অংশ ব্যক্তিগত ভাগ্যান্বেষণের আশায় তৎকালীন ক্ষমতাশীন দল বি এন পি’তে যোগদান করেন।রয়ে যায় মুষ্টিমেয় কিছু নেতা কর্মী।সেই মুষ্টিমেয় উল্লেখযোগ্য নেতা কর্মীদের মধ্যে ‘ফরিদুল ইসলাম ফরিদ’অন্যতম।তার সেই সময়ের অবস্থান অনুযায়ী তিনি দল ত্যাগ
করে বি এন পি’তে গেলে নিশ্চিত ভাবে এম পি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের
ডান হাত হতে পারতেন,ঠিকাদারী করে,রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে ব্যাবসা বানিজ্য করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারতেন।কিন্তু ব্যক্তিগত লোভ লালসাকে জয় করে মানসিকভাবে
দৃঢ় থেকে তিনি ছাত্র মৈত্রীর সাথেই ছিলেন। এর মধ্যে
তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক(সম্মান)শেষ
করে এম বি এ পড়ার জন্য ঢাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন।তখন ছাত্র মৈত্রীকে আবার কলেজ ক্যাম্পাসে
সংগঠিত করার চেষ্টা করছে তৎকালীন জেলা ছাত্র মৈত্রী’র সভাপতি,
ত্যাগী ছাত্রনেতা বিপ্লব কুমার রায়।কলেজ ক্যাম্পাসে তার অবস্থা তখন সদ্য সিংহাসনচ্যুত প্রতাবশালী
সম্রাটের মত।লুঙ্গী আর শার্ট
পরে কলেজ ক্যান্টিনের বারান্দায় তিন চারজন কর্মী নিয়ে বসে গল্প করে প্রতিদিন সময় কাটান।সামনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ছাত্র মৈত্রী’র একক প্যানেল দেওয়াই দুরূহ ব্যাপার। সেই
সময় আমি স্নাতক(সম্মান)হিসাব বিজ্ঞান দ্বিতীয়
বর্ষের ছাত্র।সাংবাদিকতা ও বি
এন সি সি’র সাথে জরিত থাকার কারণে ক্যাম্পাসে মোটামোটি পরিচিতি ছিলো।সক্রিয় রাজনীতিতে তখনো আমি জরিত নই এবং ইচ্ছেও
ভেতরে কাজ করেনা।রাজনীতি না করলেও
সব দলের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় ছিলো সাংবাদিকতা করার কারনে।সেই সুবাদে বিপ্লব দা’র শুভাকাঙ্খি
হিসেবে তার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিলো।এ সময় দলের এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লব দা আমাকে ছাত্র মৈত্রীতে
সক্রিয় হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন।সঙ্গে যুক্ত হলেন ছোট ভাই আরাফাত রহমান।দু জনের নিয়মিত অনুরোধের ফলে এক সময় সক্রিয়
হতে রাজি হলাম এবং সক্রিয় কর্মী হিসেবে নিজেকে আত্নপ্রকাশ করে ছাত্র মৈত্রী’র জন্য কাজ করতে লাগলাম।পড়াশুনার
পাশাপাশী নতুন এক ব্যস্ততা ও চ্যালেঞ্জ শুরু হলো জীবনে। তখন ওয়ার্কাস পার্টি ও ছাত্র মৈত্রী থেকে সদ্য চলে যাওয়া রুপান্তরিত বি এন পি’র নেতাকর্মীরাই ছাত্র মৈত্রী’র কর্মীদের জন্য বড় থ্রেড হয়ে দাড়িয়েছিলো।এই প্রতিকূলতার মধ্য থেকেই দলকে ঘুরে দাঁড় করার জন্য ফরিদ ভাই মাঝে মাঝেই ঢাকা থেকে রাজবাড়ী ছুটে চলে আসতেন, কর্মীদের ক্যাম্পাসে সদর্পে টিকে থাকার জন্য সাহস সঞ্চার করে উজ্জীবিত করতেন।মিছিলে নিজে শ্লোগান দিয়ে কর্মীদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য আনার চেষ্টা করতেন।কর্মীদেরকে দলীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সচেতন ও সজাক করতে প্রতি শুক্রবার পার্টি অফিসে প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর আয়োজন করা হতো, সেই কর্মশালায় এ্যাডভোকেট শফিক ভাই,বিপ্লব দা,রেজা ভাইয়ের গঠনমূলক ও যুক্তিনির্ভর আলোচনা যেমন কর্মীদের মধ্যে উদ্দিপনার সৃষ্টি করতো,তেমনি ফরিদ ভায়ের সহজ সরল ভাষার আলোচনা বাড়তি প্রাণের সৃষ্টি করতো।দলের প্রতিটি ছেলের সাথে তিনি কখনো নেতা হিসেবে মিশতেন না, মিশতেন ভাইয়ের মত, সহপাটি বন্ধুর মত।কেউ দুষ্টুমি করলে উনি মজা করে একটা শব্দ ব্যাবহার করতেন।বলতেন এইসব ‘ফুক্কু’ মারা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দে।ফুক্কু শব্দটি উনি মূলত বাদরামী অর্থে ব্যবহার করতেন।কর্মীদের মনোযোগ আকর্ষন করতে তার ছিলো এক অদ্ভুত ক্ষমতা।তখন ছাত্র মৈত্রী’র কেন্দ্রীয় নেতৃবিন্দু মাঝে মাঝেই রাজবাড়ীতে আসতেন।একবার তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি দীপংকর সাহা দীপু রাজবাড়ীতে এলেন।সারাদিন ব্যাপী পার্টি অফিসে এক কর্মশালার আয়োজন করা হলো।সকাল থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি দেশের সামগ্রীক অবস্থা,ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংগঠন তথা ছাত্র মৈত্রী’র ভূমিকা সহ সমসাময়িক নানা গুরত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সুদীর্ঘ বক্তৃতা করছেন,চা পানের বিরতি না থাকায় একটানা বক্তৃতা শুনতে শুনতে রুম ভর্তি কর্মীদের মধ্যে মনোযোগে চ্যুতি ঘটলো, তখন দীপু দা বিরতিতে গিয়ে আলোচনায় আসলো ফরিদ ভাই,তিনি আলোচনা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাস্যরস্য কথার ফুলঝুরি দিয়ে রুম ভর্তি বুভুক্ষু নেতা কর্মীদের মধ্যে মুহূর্তেই হাসির ফোঁয়াড়া বইয়ে দিলেন।এরকম অনেক মজার মুহূর্তের স্মৃতি রয়েছে ফরিদ ভায়ের সাথে।
ফরিদ ভাই ছিলেন একজন শ্রমজীবী পিতার সন্তান, মিটিংয়ে কখনো কখনো নিঃসংকোচে নিজের পিতার পেশাকে উদাহরণ টেনে কর্মীদের বোঝাতেন এবং সমাজ স্বীকৃত প্রতিটি পেশার প্রতি সম্মান ও সমান গুরত্ব অনুধাবনের ঈঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতেন।
ছাত্র মৈত্রীর এই ভঙ্গুর অবস্থা নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে আবার পুনর্জাগরণ ঘটে।ঐ সময় বিপ্লব দা ও ফরিদ ভায়ের সঙ্গে দলকে পুন-স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে ছাত্র মৈত্রীর যে ছাত্র নেতাদের নাম আপনা আপনিই চলে আসে তারা হলেন সুজন আলী বিশ্বাস,ফরহাদ ,রাকিব হোসেন সুমন, ,পিন্টু,আরাফাত রহমান,রাজু আহম্মেদ,হান্নান,রকি,সাইদুর মিতুল,রবিন,সফিক,তুষার সহ আরো অনেকে।
২০০২ সাল,রাজবাড়ী সরকারী কলেজে ২০০১-২০০২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রসংসদ নির্বাচনের তফশীল ঘোষনা করা হলো।ছাত্র মৈত্রী সেই নির্বাচনে পদ ভাগাভাগীর ভিত্তিতে আওয়ামী ছাত্রলীগের সাথে ঐক্য করে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছাত্র ঐক্য প্যালেন দিলো, আর প্রতিপক্ষ ছাত্র শিবির সমর্থিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একক প্যানেল।তৎকালিন ক্ষমতাশীন ছাত্র সংগঠনের সাথে নির্বাচনী লড়াইটা ছিলো অনেকটা চ্যালেঞ্জের।সেই নির্বাচনে আমাকে দল থেকে বার্ষিকী সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিলো।নির্বাচনে ক্ষমতাশীন দল বি এন পি’র নেতা কর্মীদের নিকট থেকে নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও থ্রেড আসতে লাগলো।এসব উপেক্ষা করে আত্নসম্মান রক্ষার এই নির্বাচনী লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে ওয়ার্কাস পার্টির নেতৃবিন্দু মাঠে নামলেন, সেই সাথে ঢাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রেখে রাজবাড়ীতে চলে আসলেন ফরিদ ভাই।ফরিদ ভাই কলেজের অনার্স কোর্সের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কলেজ তথা ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের স্বার্থে আমাদের প্যানেলেকে ভোট দেয়ার জন্য গঠনমূলক আলোচনার ভেতর দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন।পার্টির নির্দেশনা অনুযায়ী আমরাও প্রাণপন খেটেছিলাম।২০০২ সালের ১০ অক্টোবর নির্বাচনের দিন আমরা সারাদিন কলেজে অবস্থান করার পর প্রতিপক্ষের আক্রমনের আশংকা করে ঊর্ধতন নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ফলাফল ঘোষনার পূর্বে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিলাম।আমাদের অনুপস্থিতেই নির্বাচনী ফলাফল ঘোষনা করা হলো।পঁচিশটি পদের মধ্যে আমাদের প্যানেল থেকে তেরজন প্রার্থী নির্বাচিত হলো।সংসদের মূল ভিপি’র পদটি আমাদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলো,ছাত্রলীগের রাকিবুল হাসান পিয়াল ভাই।তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ছাত্রমৈত্রী থেকে মনোনয়ন প্রাপ্ত ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাবেক এজিএস, পরবর্তিতে দল পরিবর্তন করে ছাত্রদল থেকে ভিপি মনোনয়ন প্রাপ্ত আহম্মেদ হোসেন সাগর। ছাত্র মৈত্রী থেকে আমিসহ আটজন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম।দলে এমন ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ঘুরে দাড়িয়ে আমাদের এমন ফলাফল যতেষ্ট সন্তোষজনক ছিলো।দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নতুন করে দল পুনর্গঠনের আশা সঞ্চার করেছিলো।
২০০৪ সালের মধ্যে আমার স্নাতক(সম্মান)কোর্স সম্পন্ন হওয়ার সাথে ছাত্র সংসদের যাবতীয় দায় দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলো।সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় গিয়ে এমবিএ অথবা সিএ পড়বো, সেই সাথে স্নাতকোত্তর কোর্সটা কোন ভালো কলেজ থেকে সম্পন্ন করে নেবো।সেই উদ্দেশ্যে আমি আর আমার বন্ধু বিপুল ঢাকায় আসলাম।বিপুল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে মাষ্টার্স কোর্সে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করতে এসেছে।তখন ঢাকায় আমাদের ভালো বুদ্ধি পরামর্শ দেয়া এবং কোথাও দু চারদিন অবস্থান নেওয়ার মত আপনজন ছিলোনা।প্রথম দিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর অনেকটা উপায়ন্ত না পেয়ে বিপুল নদীর ওপার কেরানীগঞ্জে ওর দুঃসম্পর্কের এক আত্নীয়ের বাসায় নিয়ে গেলো।ঐ বাসায় দুইদিন অবস্থান নিয়ে নতুন শহরে অসহায়ের মত বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলো ঘুরতে লাগলাম।ফরিদ ভাইয়ের মোবাইল ফোন নম্বর আমার নোটবুকে ছিলো।পরে ফার্মগেটের একটা ফোনের দোকান থেকে ওনাকে ফোন দিলাম, ফোন পেয়ে উনি বাসার ঠিকানা দিয়ে বললেন,আমি বাসায় আছি তাড়াতাড়ি চলে আয়,পরে সবকিছু শোনা যাবে।আমরা দুজন ফরিদ ভায়ের মিরপুর শ্যাওড়াপাড়ার বাসায় চলে আসলাম।কলিংবেল টিপতেই ফরিদ ভাই দরজা খুললো ,ওনাকে দেখা মাত্রই মনের মধ্যে অন্যরকম এক প্রশান্তি ও নির্ভরতা অনুভব করলাম।তিনজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বসবাস করা ম্যাচ বাসাটি এত পরিপাটি ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন দেখে ব্যাচেলর বাসা ভাবতেই একটু হোঁচট খেতে হলো।দুই রুমের ফ্ল্যাটটিতে পড়ার টেবিলগুলো বই দিয়ে সাজানো।প্রত্যেকের সামনে সেমিষ্টার ফাইনাল পরিক্ষা,পড়াশুনা নিয়ে সবাই চাপের মধ্যে আছে।কিন্তু আমাদেরকে তা বুঝতে দিলেন না। আমরা আসবো তাই বুয়াকে দিয়ে অতিরিক্ত রান্না করে রাখা হয়েছে।ফ্রেস হয়ে সবজি দিয়ে রান্না করা নছি
মাছের ঝোল তরকারী আর ডাল ভাত তৃপ্তি-সহকারে
খেলাম ।ফ্লাটের অন্য দুজনের সাথে আলাপ পরিচয় হলো।একজনের নাম মিজান অন্যজনের নাম ভুলে গিয়েছি।দুজনই বেশ মিশুক এবং ফরিদ ভাইয়ের
বেশ ভক্ত।ফরিদ ভাই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র তাই বড় ভাই সুলভ একটু কর্তৃত্বের ভাব লক্ষ্য
করলাম।ঐদিন কেউ আর পড়ার টেবিলে
বসলোনা।গল্প শুরু হয়ে গেলো।সেই পার্টির কর্মশালার মত , ফরিদ ভাই বক্তা আর আমরা সবাই শ্রোতা।ভাববাদ ,বস্তুবাদ ,সমাজতন্ত্রের উপর
তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিবেশ কিছুক্ষণের মধ্যে গম্ভীর
করে ফেললেন।কারণ এই আলোচনায় ওনার সঙ্গ দেয়ার মত আমাদের মধ্যে কেউ নেই।সবাই চুপ।আমি নিজেও যদিবা একটি সমাজতান্ত্রিক দলের ছাত্র সংগঠনের
একজন কর্মী কিন্তু ঐ সময় এই বিষয়গুলোর উপর আমার কনসেপ্ট তেমন পরিস্কার ছিলোনা।(এই বিষয়গুলোর বুঝতে পেরেছি
প্যারিসে আসার পর সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ শ্রদ্ধেয় কামরুজ্জামান জুয়েলের সান্নিধ্যে)।ফরিদ ভাই বুঝতে পেরে এই আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করলেন না।ওনার কিছু ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার কথা আমাদেরকে বললেন।এম বি এ শেষ করার পর জীবীকার জন্য একটা ব্যবসা শুরু করবেন, পাশাপাশী রাজনীতি চালিয়ে যাবেন।রাজনীতিতে আরো পরিপক্কতা ও সিনিয়র হওয়ার পর রাজবাড়ীর ১ আসন থেকে দলীয় মনোনয়নে এম পি নির্বাচন করবেন।বললেন তোরা ছাত্র মৈত্রী’র দুইশ ভাই পড়াশুনা শেষ করে ভালো চাকুরী করবি আর আমার নির্বাচনী খরচ তোরা দিবি।একজন দশ হাজার টাকা করে খরচ করলেও বিশ লক্ষ টাকা খরচ হবে।নির্বাচিত হলে নিজ জেলার মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত এবং জ্ঞাননির্ভর হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি কিছু কর্মকান্ড বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নেবেন।এই পরিকল্পনা সফল করতে প্রথমেই প্রতিটি ওয়ার্ডে এলাকার আর্থিক সচ্ছল ও মান্যবর ব্যক্তিদের সহায়তায় একটি করে লাইব্রেরী স্থাপন করবেন,যেখান থেকে এলাকায় তরুন সমাজের মধ্যে
পাঠ্যভাস গড়ে ওঠার ভেতর দিয়ে সমাজ সচেতনতাবোধ সৃষ্টি হবে।আর সমাজ সচেতন জনগোষ্ঠী ও নেতৃত্বের
সৃষ্টি হলে জনগন রাষ্ট্রের কাছ থেকে তার প্রাপ্য অধিকার যেমন বুঝে নিতে সচেষ্ট হবে ,অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও জাতীয়তাবোধের ব্যাপারেও
সজাগ হবে। মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করে যাওয়ার আশা ব্যক্ত
করলেন, বিনিময়ে প্রত্যাশা করলেন, পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের দিনে মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসার চোখের এক ফোঁটা জল এবং জানাজায় অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি।
ফরিদ ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনে অনুপ্রেরণার আর এক উৎস ছিলেন তাঁর স্ত্রী লাভলী ।তখন লাভলী আপার সাথে ফরিদ ভাইয়ের বিয়ে হয়নি,উভয় পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথা চলছে।লাভলী আপা বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করেছে।তাকে নিয়ে কিছু স্বপ্নের কথা আমাদের সাথে ভাগ করলেন।বললেন,আপাকে ল কলেজে আইন পড়াবেন,পাশ করে বের হলে রাজবাড়ী কোর্টে যাতে আইনজীবি হিসেবে কাজ করতে পারেন,সেইসাথে দলীয় নেতা কর্মীদের রাজনৈতিক হয়রানী রোধে তিনি যেন আইনগত সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারেন।আপার প্রশংসা করে বললেন,লাভলীকে আমি বেশী পছন্দ করি যে কারণে তা হলো সোঁদা মাটির গন্ধ লাগানো আমার বাবা মায়ের সাথে ও আপন করে মিশতে পারবে।
পরের দিন সকালে ফরিদ ভাই আমাদের নিয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে গেলেন।তখন ইউ আই ইউ নতুন চালু হয়েছে এবং নিজস্ব ক্যাম্পাস তৈরী হয়নি,ধানমন্ডির সাত মজজিদ রোড়ে অবস্থিত একটি ভাড়া করা বিল্ডিংয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।ফরিদ ভাই বিজনেজ ফ্যাকাল্টির এক শিক্ষককে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।যিনি ওনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, পরে ইউ আই ইউ তে চলে এসেছেন।আমার ভর্তির ব্যাপারে আলাপ করলেন এবং টিউশন ফি সর্বাত্মকভাবে কমানোর জন্য অনুরোধ করলেন।আলোচনার পর টাকার একটা বড় অংক কমিয়ে স্যার আমাকে ভর্তি করতে রাজী হলেন।যদিও পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়া হয়নি।ছাত্রমৈত্রী’র দুই একজন কর্মীকে ফরিদ ভাই ফ্রি টিউশন ফিতে সম্পর্কের ভিত্তিতে এই বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি করেছিলেন এবং কিছু কর্মীকে টিউশন ফি ছাড়ে ভর্তি করেছিলেন।যারা পড়াশুনা শেষ করে এখন কর্মে নিয়োজিত আছেন।রাজনীতির কারণে যেসব কর্মীর পড়াশুনায় ছেদ পড়েছিলো তাদেরকে পুনরায় পড়াশুনায় দিয়ে ধাবিত হওয়ার জন্য তার সর্বাত্বক চেষ্টা ও অনুপ্রেরণার অব্যহত রেখেছিলেন।
এরপর ২০০৬ সালে, আমি ঢাকা তিতুমীর কলেজ থেকে হিসাবশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর একটি মুনাফাভোগী রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে হিসাব
নিকাসের কাজ জুটিয় নিয়েছি।জীবীকার ব্যবস্ততায় ঢাকাতেই বসবাস শুরু হলো।প্রিয় রাজবাড়ী শহর,প্রিয় মানুষদের সাথে যোগাযোগে অনিয়মিত হওয়ার কারণে দূরত্বও বাড়তে
লাগলো।আমার অফিস ধানমন্ডিতে, ব্যাংকিং কাজে মাঝে
মাঝেই বাইরে যেতে হতো।একদিন ষ্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে অফিসিয়াল লেনদেন
সেরে রিক্সায় করে অফিসে ফিরছি।হঠাৎ ধানমন্ডি লেকে আসতেই ফরিদ ভাইয়ের সাথে দেখা।সেই স্বভাবসুলব কথাবার্তা,কিরে উজ্জ্বল তুই এখানে !পড়াশুনা
শেষ করে বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়েছি যেনে খুব খুশি হলেন।জানালেন, উনি গ্যার্মেন্টস এক্সেছোরিজের ব্যবসা শুরু করেছেন।এরপর মাঝে মাঝেই ভাইয়ের সাথে ঢাকার
পথে ঘাটে দেখা হতো।দেখা হওয়া মাত্রই কেমন যেন একটা শক্তি অনুভব করতাম নিজের মধ্যে।কিছুক্ষণ কথা বলার পর আপনভূমি ছেড়ে
দূরে থাকার কষ্ট মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যেত।
২০১০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী,আমি ঢাকাতে,রাতে বাড়ী থেকে আব্বা ফোন করে
জানালো ফরিদ রোড় এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে।মুহূর্তেই এক আচমকা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম,যে মানুষটির সমাজের প্রতি,রাষ্ট্রের প্রতি
অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়ে গেছে সেই মানুষটি এখনই ওপারে চলে যায় কিভাবে !যে মানুষগুলো সমাজের আপামর জনতার ভরসা হয়ে ওঠে তাদের কেন হঠাৎ করে
চলে যাওয়ার খবর শুনতে হয় ! বিশ্বাসই হচ্ছিলোনা
ফরিদ ভাইয়ের সাথে আর দেখা হবেনা। তার শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায়
আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়নি,শুনেছি জনশ্রোতের
মধ্যদিয়ে দল মত নির্বিশেষে
জনতার অশ্রুসিক্ত নয়নে ফরিদ ভাইয়ের সমাধি হয়েছে।
যেভাবে শুনেছি ফরিদ ভাইয়ের মৃত্যুর
ঘটনা :সেই ছাত্র অবস্থাতেই মটর বাইকের প্রতি ভীষন দুর্বলতা ছিলো তার।প্রতিদিন মোটর বাইকে রাজবাড়ী শহর
প্রদক্ষিণ না করলে যেন তার
রাতের ঘুম হতো না।পাকা হাত ছিলো এই যানটির উপর। তাই আত্নবিশ্বাসও ছিলো অগাধ।সেই বিশ্বাসে মোটর বাইকে করেই মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে নিজ শহরের
টানে রাজবাড়ী ছুটে আসতেন। ২০১০ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাস, দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে একুশ উদযাপনের জন্য ছুটে এসেছিলেন রাজবাড়ীতে
।রাত বারোটা এক মিনিটের পর দলের পক্ষ থেকে ভাষা শহীদদের স্মরণে রাজবাড়ী সরকারী কলেজে
অবস্থিত শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।দিনের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন একুশের কর্মসূচি নিয়ে।এর পর বন্ধু ও নেতাকর্মীদের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে আত্নবিশ্বাসী মোটর বাইকে চেপে বসে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে ।রাজবাড়ী থেকে ঢাকার ১২৫ কিলোমিটার
পথের অধিকাংশ পথই অতিক্রম করেছিলেন।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে , গোধুলী আলোয় ঢাকার ধামরাই পৌঁছানোর পর এক পন্যবাহী ঘাতক ট্রাক আক্রমন করে বসে তার বাইককে
লক্ষ্য করে ,তিনি মোটরবাইক থেকে ছিটকে পরেন ট্রাকের চাকার নিচে ,মুহূর্তেই পিষে
যায় তার শরীর।চিরতরে নিভে যায় এই ক্ষণজন্মা মহান
পুরুষের প্রাণ প্রদীপ।
প্রিয় ফরিদ ভাই, তুমি আজ তোমার রক্ত মাংশের শরীর নিয়ে আমাদের মাঝে নেই।কিন্তু তুমি বেঁচে আছো, তোমার কর্মে,বেঁচে আছো রাজবাড়ী বাসীর স্মৃতিতে,বেঁচে আছো তোমার স্নেহে ধন্য হওয়া শত ভাইয়ের মস্তিষ্কে।আমরা তোমাকে ভুলিনি,যেখানে আছো আশা করি ঐ মহান সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ভালো রেখেছে।আজকের তোমার প্রয়ান দিবসে তোমাকে সশ্রদ্ধ সালাম এবং ভালোবাসা ……………..
মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
প্যারিস,ফ্রান্স
ফরিদ ভাইয়ের সাথে সবচেয়ে বেশি আমার সময় কেটেছে। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। অসাধারণ লেখা
উত্তরমুছুনএখনো মনে হয়না, ফরিদ ভাই আমাদের মাঝে নেই ।
মুছুন