ফরাসি সীমানার বৃত্তে ঘুরপাক
খাচ্ছিলাম পাচঁ বছর।মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হতো এই
বৃত্ত অতিক্রম করে ঘুরে আসি সীমানা পাড়ি দিয়ে অন্য কোথাও থেকে।কিন্তু সময় অনুকূলে না থাকায় হয়ে উঠছিলো না সেই
সুযোগ।এবার এক সপ্তাহের জন্য পরিবারের সঙ্গে অবকাশ যাপনের
পরিকল্পনা ছিলো ফ্রান্সের বরদু শহরে।এর মধ্যে প্যারিসের একজন প্রিয় বন্ধু কামরুল হাসান
উজ্জ্বল ভাই ফোনে আমন্ত্রণ জানালেন সপরিবারে স্পেনের বার্সেলোনায় ঘুরতে আসার।উপলক্ষ্য অবশ্য আরও একটি রয়েছে, তাহলো বার্সেলোনায় বাংলাদেশ সমিতির আয়োজনে বৈশাখী মেলা
উদযাপনের অংশ হওয়া।তবে আমার স্ত্রী জান্নাত ও মেয়ে মিশেলের স্কুলের
ব্যস্ততার কারণে ওদের আমার ভ্রমণসঙ্গী হওয়া সম্ভব হলো না।তাই আমি একাই যাওয়ার জন্য মন স্থির করলাম।তবে প্যারিস থেকে আমন্ত্রিতদের তালিকায় আরো রয়েছেন
পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুল দম্পতি ,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসনাত জাহান এবং চিত্র শিল্পী মুহিত জ্যোতি।এর মধ্যে মুহিত জ্যোতি বিমান টিকেট বুকিং করেছেন
আর বাকিরা যাবেন বাসে।বাস ভ্রমন দীর্ঘ হলেও যাত্রাপথের
দৃশ্য দেখার আনন্দ নেওয়া যায়।তাই আমিও
অন্যান্য অতিথিদের সাথে বাসে যাত্রা করার জন্য ২৭ মে’র একটি টিকেট বুকিং করলাম।এর ফলে প্যারিস থেকে আমাদের আমন্ত্রিতদের মধ্যে
বাসে সফর সঙ্গিদের সংখ্যা দাড়ালো চারজন।এরমধ্যে
আমাদের ভ্রমণকে উপভোগ্য করার জন্য নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে রামবুতা’র ফ্লনস রেস্তোরায় বসে সবাই এক সন্ধ্যায় একটি
ভ্রমণ পরিকল্পনা তৈরি করলাম।দীর্ঘদিন
পর ফরাসি সীমানার বাইরে অন্যকোন দেশ পরিভ্রমণে যাচ্ছি তাই আমার মধ্যে উৎসাহ এবং উদ্দিপনা
একটু বেশী অনুভব করছিলাম।তার উপর ফটোগ্রাফির এক দুর্দান্ত
নেশা রয়েছে আমার মধ্যে,নতুন
কোন স্থানে গিয়ে নতুন কোন বিষয়ের উপর ফটোগ্রাফির আনন্দটাও একটু ভিন্নরকম হয়,
তাই ভ্রমণ উপলক্ষ্য নাইকনের ৫৫-৩০০ মিলিমিটারের
একটি ক্যামেরা লেন্সও কিনে ফেললাম।দীর্ঘ পনের ঘন্টার ভ্রমণ পথ তাই খাদ্য ও পানীয় সামগ্রির ছোট খাটো একটা মজুদও সঙ্গে রাখতে হলো। ২৭ মে ভ্রমণ সঙ্গীদের সবাই প্যারিসের ব্যারছি বাস স্টেশনে বিকেল পাঁচটার মধ্যে চলে এলাম।আমার সীট জানালার পাশে সংরক্ষিত, কিন্তু বাসে প্রবেশ করে দেখি নির্ধারিত সীটটি দখল করে আছে বিশোর্ধ বয়সের হালকা পাতলা গড়নের এক তরুনী পা দুটো সীটের উপর উঠিয়ে। বসার ভঙ্গী দেখে আর ইচ্ছে হলো না মেয়েটিকে বলি জায়গা পরিবর্তন করতে, তাই পাশেই সীটেই স্থান নিলাম। আমাদের বাস সাড়ে পাঁচটায় স্পেনের বার্সেলোনা শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। যাত্রার দিন শুক্রবার হওয়াতে শুরুতেই দীর্ঘক্ষণ জ্যামের সম্মুখিন হতে হলো।শনি রবিবার দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে ফরাসিদের অনেকেই ছুটি কাটাতে ব্যক্তিগত মোটর গাড়ী নিয়ে দূরের কোন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে শুক্রবার অফিস ছুটির পর বেরিয়ে পড়ে।তাই এই দিনে স্বভাবতই ইল দো
ফন্স এর মধ্যকার মহাসড়কগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত মোটর যান পরিলক্ষিত
হয়। যাইহোক, প্রায়
দুই ঘন্টার যানজটপূর্ণ দীর্ঘ থেমে চলা পথ পেরিয়ে আমাদের বাস প্রবেশ করলো সুবুজ মাঠ আর গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা মুক্তপথে।দুই ঘন্টা মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশের ঢাকার কোন সড়কে অবস্থান করছিলাম। বাস বাধাহীন গতিতে এগিয়ে চলতে লাগলো অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যেও এক প্রাণচাঞ্চল্যতা পরিলক্ষিত
হলো।কেউ বই পড়া,কেউ ট্যাবলেট ল্যাপটপে
সিনেমা দেখা , গান শোনায় মেতে উঠলো ,কেউবা আবার আয়েশী ঘুমের দোলায় দোল খেতে লাগলো।কিন্তু জানালার বাইরের দৃশ্য আমাকে এক
মোহনীয় ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে ফেললো।দীর্ঘ দিনের ইট পাথর আর কংক্রিটের আবাস ভূমি থেকে বেরিয়ে সবুজের মধ্যে প্রবেশ করে
তৃষ্ণার্ত চোখ পিপাশা মেটাতে যেন ব্যাকুল হয়ে উঠলো।উঁচু নিচু ধু ধু ফসলী জমি,মাঠের মাঝে গড়ে ওঠা এক
চিলতে ফরাসি গ্রাম, হঠাৎ ধবল ধেনুর পাল ও ভেড়ার আপন মনে ঘাস খাওয়ার
দৃশ্য যেন আমাকে বাংলাদেশের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।কানে বেজে চলছিলো এম পি ফোরে মেহেদী হাসানের মিথিলা এ্যালবামের কবিতাগুলো।এক অন্যরকম ভালোলাগার ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিছিলাম ,এভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের এক পর্যায়ে
হঠাৎ বাস থেমে গেলো , বাসে প্রবেশ করলো সন্দেহাতীত দৃষ্টিতে দুই ফরাসি পুলিশ, সাথে দীর্ঘদেহী এক গোয়েন্দা কুকুর,উদ্দেশ্য কোন দুস্কৃতিকারী
বা বিস্ফোরক দ্রব্য খোঁজা।কোন কিছু না পেয়ে পুলিশ ও কুকুর বিদায় নিলো আবার যাত্রা শুরু করলো বাস। শুশৃংখল বনবাদার আর পাহাড়ী পথ অতিক্রম
করতে করতে আটটার দিক থেকে গোধুলী আলোয় প্রকৃতি ধূসর হতে লাগলো।উচু নিচু টিলার মধ্যে ফসলী জমির পাশ দিয়ে
গড়ে ওঠা পশুর খামারে সাদা শুকুর আর ধবল ভেড়ার পাল ক্লান্ত দেহে বিশ্রাম নিচ্ছে। আধো আলো অন্ধকারে মনে হচ্ছিলো মাঠের মধ্যে
সাদা গোলক আকৃতির কোন বস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে।সন্ধ্যে নামার একটু আগে, নয়টা'র দিকে আমাদের বাস ত্রিরিস মিনিটের একটা বিরতি নিলো মহাসড়কের (অটোরুত autoroute)এর পাশে সুবিশাল পাহাড়ের কোল ঘেষে অবস্থিত একটি রেস্তোরায়।মহাসড়কের পাশে এ ধরনের রেস্তোরাগুলো মূলত গড়ে তোলা হয়েছে যাত্রীদের সুবিধার্থে। কারণ দীর্ঘ যাত্রায় যাত্রীরা বিরতিতে এখান থেকে তাদের ক্ষুধা নিবারণের কাজটি সেরে নিতে পারেন এবং রিফ্রেসমেন্টের পাশাপাশী প্রয়োজনীয় পানীয় দ্রব্য ও খাবার সংগ্রহ করতে পারেন। ফরাসিতে এই ধরনের যাত্রাবিরতির জায়গাকে এ্যার(aire)বলা হয়।
আমাদের ভ্রমনসঙ্গীদের চারজন সঙ্গে আনা খাবার দিয়ে রেস্তোরার বাইরে তেরাসে(terrasse)বসে এক সঙ্গে ডিনার সেরে নিলাম।খাবার গ্রহণের পাশাপাশী প্রকৃতি ও ভ্রমণ নিয়ে আমাদের মধ্যে টোট্ট একটা আড্ডাও হয়ে-গেলো। কাব্য কামরুল
ভ্রমণ প্রিয় মানুষ,ভ্রমণ সংক্রান্ত পড়াশোনাও রয়েছে তার।উনি একজন বিখ্যাত ভ্রমণ বিষয়ক লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন,কোথাও ভ্রমণে গেলে ঐ স্থানের সঙ্গে আপনার ভালোলাগা অন্যকোন দেশ বা স্থানের তুলনা করা সমীচীন নয়, কারণ প্রতিটি অঞ্চলের ভিন্নতা
গড়ে ওঠে তার নিজস্ব ইতিহাস,
ঐতিহ্য,রাজনীতি,শিল্প সংস্কৃতি
ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যে ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারার উপর।আর ভ্রমণে মজাই হচ্ছে এই ভিন্নতার স্বাদ
নেওয়া।তুলনামূলক বিচারে গেলে নতুনত্বের
স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।এর মধ্যে উঠে এলো বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত গানের কথার প্রসঙ্গে কিছু কথা « এমন
দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি »আমরা
এতক্ষণ এত সবুজ,এত সাজানো মাঠ ঘাট পাহাড় প্রান্তর পেরিয়ে আসার পর মনে হলো এই গানের কথাগুলো
সত্য নয় তবে কথাগুলো কবির গভীর দেশপ্রেমের একান্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ।প্রতি দেশের সৌন্দর্যের ভিন্নতা রয়েছে, সেই সৌন্দর্য সরাসরি চোখ
মেলে দেখে তুলনা করার সৌভাগ্য এক জীবনে একজন মানুষের হয়ে ওঠেনা , তাই নিজের দেশ বা বৃত্তের মধ্যে চোখে দেখা প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন হয়ে তার বাস
ভূমিকে পৃথিবীর সেরা মনে হয়, সকল দেশের রানী মনে হয়।এই মনে হওয়াটা হচ্ছে মাতৃভূমির প্রতি মমত্ব
ও ভালোবাসার উপলব্ধি অন্যকোন দেশের সৌন্দর্যকে ছোট করা নয়।
বাস আবার যাত্রা শুরু করলো ,কিছুক্ষণ সন্ধ্যের গোধুলী আলোয় দূরের মাঠ ও পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে মেঘের ভেসে
বেড়ানোর দৃশ্য দেখে চমকিত হচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে প্রকৃতিতে
নেমে আসতে লাগলো ঘোর অন্ধকার শুধু বাসের হেড লাইটের
আলোয় বাসের সামনের এগিয়ে চলার দৃশ্য দেখা যায় ,জানালার পাশের দৃশ্যগুলো মাঝে মাঝে ল্যামপোষ্টের আলোয় এক ঝলক কিছুটা ঝাপসা
দেখা গেলেও দূরের দৃশ্যে কোন গ্রাম বা স্থাপনার বিজলী বাতির আলোর বিচ্ছুরণ ছাড়া কিছুই
চোখে ধরছিলোনা।এর মধ্যে শুরু
হলো বৃষ্টির প্রবল বর্ষণ,এমন ঝুম বৃষ্টি প্যারিসে কখনো দেখা হয়নি,চলন্ত বাসের
ছাদে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে শরীরে এক দারুন শিহরণ অনুভব করলাম,মনে হলো দেহ মন কিছুক্ষণের জন্য অবস্থান করছে আষাঢ়ের দিনে গ্রাম বাংলার কোন
টিনের চালা ঘরে।
রাত রারোটার দিকে আমরা পৌঁছুলাম ফ্রান্সের লিঁও শহরে।এখানে বাস পনেরো মিনিটের রিরতিতে প্যারিস থেকে আগত লিঁও শহরের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বার্সেলোনা গামী
যাত্রী তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো।শহরের মধ্য দিয়ে যাত্রা-কালীন সময়ে রঙিন আলোয় দেখা হলো মধ্য রাতের শান্ত স্নিগ্ধ লিঁও শহরের কিছুটা অবয়ব।বাসের যাত্রীদের অনেকেই জানালার পর্দা
টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে।লিঁও থেকে আমার সহযাত্রীনী
পরিবর্তন হয়ে আমার পাশের ছিটে অবস্থান নিয়েছে নতুন সহযাত্রীনী। সেও বাস চলার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমের ঘোরে
চলে গেলো কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।নিস্তব্ধ রাতের শান্ত প্রকৃতির মধ্যদিয়ে অবিরাম ছুটে চলছে বাস।চোখে কখনো তন্দ্রা এসে ভর করছে, আবার চলে যাচ্ছে।আধো ঘুম আধো জাগরণের দোলায় দুলতে দুলতে
রাত সাড়ে তিনটায় এসে পৌছুলাম ফ্রান্সের নিম শহরে।বাসের ক্যাপ্টেন(এখানে এধরনের দূরবর্তী যাত্রীবাহী বাসের ড্রাইভারদেরকে
ফরাসি ভাষায় কাপিতান বলা হয়)ঘোষনা করলেন, এর পর বাস ফরাসি সীমানার মধ্য
আর বিরতি না নিয়ে সরাসরি স্পেন চলে যাবে এবং বাসের মধ্যকার ওয়াশ রুম বন্ধ থাকবে,
তাই এখান থেকে সবাইকে ফ্রেস হয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন।এখানকার একটি পেট্রোল ষ্টেশনে বাস ত্রিশ
মিনিটের বিরতি নিলো।অনেকেই বাস থেকে
নেমে ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করতে লাগলো।আমাদের গ্রুপের সবাই সঙ্গে আনা খাবার শেয়ার করে খেলাম।নিম শহরের কথা ভেবে কাব্য ভাইয়ের হঠাৎ
মনে পড়লো ,এই শহরেইতো আবৃত্তি শিল্পী ও লেখক রবি শংকর মৈত্রী স্বপরিবারে বসবাস করেন ।উনি একবার ফোন করে রবিদাকে বলতে চাইলেন ,আমরা এখন আপনার শহরে অবস্থান করছি কিন্তু গভীর রাতের কথা ভেবে আবার বিরত রইলেন ফোন করা
থেকে।
এখান থেকে যাত্রার পর কখন যে গভীর ঘুমে চলে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। সকাল সাতটার দিকে বাসের ক্যাপ্টেনের ঘোষনায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখে পাতা উল্টোতেই জানালার ভেদ করে দেখা মিললো সুবিশাল জংলা পাহাড়,পাহাড়ী ভূমিটা দেখতে অনেকটা ভয়ংকর রকমের।বাস আবার একটা এ্যর(aire) এ পনেরো মিনিটের বিরতি নিলো।বুঝতে পারলাম এখন স্পেনের ভূমিতে অবস্থান করছি।বাস যখন তার নির্দিষ্ট গন্তব্য বার্সেলোনার দিকে যাত্রা শুরু করলো তখন ফ্রান্সের সাথে স্পেনের ভূ-প্রকৃতি,বাসস্থান,স্থাপনার পার্থক্যগুলো পরিলক্ষিত হতে লাগলো।যখন শহরের মধ্যে প্রবেশ করলাম তখন ঢাকা শহরের সাদৃশ্য খুজে পেতে লাগলাম।বিল্ডিং,ওভারব্রিজ,বিলবোর্ড,ব্যস্ত সড়কের এত বেশী সাদৃশ্য দেখে মনে হলো, আমি হয়তো দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আমার সুপরিচিত ঢাকা শহরে ফিরে এসেছি।আটটা পনেরো মিনিটে আমাদের যাত্রীবাহী য়ুইবুছ(ouibus)দীর্ঘ পনেরো ঘন্টার যাত্রার যবনিকা টানলেন বার্সেলোনার বাস টারমিলালে।বাস থেকে নামতেই আমাদের জন্য অপেক্ষমান দৃষ্টিতে দাঁড়ানো উজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে দেখা।সেই চিরচেনা হাস্যজ্জল মুখে আমাদেরকে অভিবাদন জানিয়ে মেট্র ষ্টেশনে নিয়ে গেলেন।
আর্ক দো ত্রিওফ মেট্র ষ্টেশন থেকে পাতাল ট্রেনে আমরা নামলাম প্লাস দো কাতালোনিয়ায়।কিছুটা পথ হাটতে হলো।উজ্জ্বল ভাই শহরের কিছু নিয়ম কানুন সম্পর্কে ব্যাখা করতে লাগলেন।ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে প্যারিসের সঙ্গে এই শহরের পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন।প্যারিসে ট্রাফিক সিগন্যালের সবুজ বাতি নেভার পরও পথচারী রাস্তা পারাপারের কিছুটা সময় পান কিন্তু বার্সেলোনায় সবুজ বাতি নেভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী চলাচল শুরু হয়ে যায় সুতরাং অভ্যাসবসত আমরা যেন এখানে সবুজ বাতি নেভার পর রাস্তা পারাপার না হই।এ ব্যাপারে আমাদের প্রথমেই সতর্ক করলেন। যে এলাকা দিয়ে উজ্জ্বল ভাই আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই এলাকার বিল্ডিং,ওলিগলিগুলো সম্পূর্ণ আমাদের পুরান ঢাকার মত।আমার কিছুতেই মনে হচ্ছিলোনা আমি ইউরোপের কোন আধুনিক শহরে প্রবেশ করেছি।পুরাতন স্থাপত্যশৈলির দালানগুলোর প্রতিটি ফ্লাটের বেলকুনিগুলোতে কাঁচা কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়েছে,যা অসংখ্য।সাধারণত প্যারিসে এমন দৃশ্য দেখা যায়না তাই একটু হোঁচট খেলাম।ছোট ছোট ওলিগোলির মধ্যদিয়ে দু একজন ফেরিওলারও দেখা মিললো।প্যারিসের মত এখানেও ইউরোপিও ইতিহ্যবাহী রুটি ও কেকের দোকান রয়েছে,আটা ময়দার তৈরির নানা প্রকার খাদ্য সামগ্রির আকৃতিগত নান্দনিকতার মিল থাকলেও স্বাদের তারতম্য রয়েছে।ফ্রান্সে এমন খাবারের দোকানগুলোকে বলা হয় বুলোনজেরি।এমন একটি খাবারের দোকান থেকে উজ্জ্বল ভাই আমাদের সকালের নাস্তার জন্য কিছু বাহারি স্বাদ ও আকৃতির খারার কিনলেন।প্লাসা মাগবা’র পাশেই এমন একটি এলাকাতে উজ্জ্বল ভাই প্যারিসের পাশাপাশী এখানে ছোট্ট এক নীড় বেধেছেন।সেই নীড়ে গত পাঁচ মাস আগে ছোট্ট এক অথিতির আগমন ঘটেছে,তার নাম রাখা হয়েছে উজ্জ্বল ভাইয়ের শাশুড়ি অর্থাৎ লুনা ভাবির মায়ের মায়ের নাম অনুসারে ‘আঞ্জু’।আঞ্জু’র বড় বোন ফিরোজা,বয়সে আন্জু’র দেড় বছরের বড়।ফিরোজার নাম রাখা হয়ছে উজ্জ্বল ভাইয়ের মায়ের নাম অনুসারে।নাম রাখার এই অভিনব কৌশলের মাধ্যমে তাদের দুই মায়ের স্মৃতির বন্ধনকে অটুট রাখার প্রয়াস চালানো হয়েছে।পিঠাপিঠি দু বোনের হাসিখুশি খেলাধুলা আর উজ্জ্বল ভাই লুনা ভাবির আদর ভালোবাসায় ভরপুর ছোট্ট বাসাটি যেন একটুকরো স্বর্গ। সেই স্বর্গে প্রবেশ করতে এক আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো।অনেক দিন পর অতি পরিচিত আপন মুখগুলো একসাথে দেখে সবার মধ্যে পুলক অনুবভ হলো। রাতভর যাত্রার ক্লান্তি সবার চেহারায় ফুটে উঠেছে,সবাই গোছল ও সকালের নাস্তা সেরে নেয়ার পর কিছু সময় রেষ্ট নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম উজ্জ্বল ভাইয়ের নির্দেশনায় বার্সেলোনা শহর পরিভ্রমনে, সঙ্গে দুই ক্ষুদে পর্যটক আঞ্জু ও ফিরোজা। প্রথমেই আমরা গেলাম প্লাস দো কাতালোনিয়া। এখানে দেখা মিললো শত শত কবুতর আর পর্যটকের এক অন্য রকম মিলন মেলা।পর্যটকদের সাথে এখানকার কবুতরগুলোর দারুন এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।কিছু গমের দানা হাতে নিয়ে ওদের আহব্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কাছে চলে আসে,হাতের উপর, ঘাড়ের উপর বসে।কবুতরগুলোকে আতিথেয়তার জন্য এখান থেকেই এক ইউরোর বিনিময়ে ছোট প্যাকেটের গমের দানা কিনতে পাওয়া যায়। আমরাও কিছু গমের দানা সংগ্রহ করে কবুতরগুলোর সাথে সবাই কিছু সুন্দর সময় উপভোগ করলাম।
এই প্লাস দো কাতালোনিয়া মূলত বার্সেলোনা শহরের কেন্দ্রস্থল।পর্যটকদের পাশাপাশী স্থানীয় কাতালান স্পানিশদেন দারুন এক আড্ডা স্থলও বটে।স্পেনের কাতালান অঙ্গরাজ্যের নাম অনুসারে এই বিখ্যাত চত্বরটির নামকরন প্লাস দো কাতালনিয়া।আর কাতালোনিয়া হচ্ছে স্পেনের একটি স্বায়ত্বশাসিত অঙ্গরাজ্য। এটি চারটি প্রদেশ বার্সেলোনা, গিরোনা, লেইদা এবং তারাগোনা নিয়ে গঠিত । এই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী এবং
সর্ববৃহৎ শহর হচ্ছে বার্সেলোনা, যা মাদ্রিদের পর স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।
কাতালোনিয়ার আয়তন ৩২,১১৪ বর্গ কিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা ৭,৫৩৫,২৫১।রাজ্যটির জনগন বর্তমান স্পেন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে আন্দোলনরত রয়েছে।
প্লাস দো কাতালোনিয়ার পর আমরা এর আশেপাশের এলাকাগুলো হেঁটে দেখতে লাগলাম।পুরান ঢাকার সাঁখারি বাজারের সাথে বেশ মিল খুজে পেলাম।সাঁখারি বাজারে যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূঁজা অর্চনার নানাবিধ সরঞ্জাম বিক্রয়ের দোকান রয়েছে, তেমনি এখানে দেখা মিললো
সেরকম কয়েকটি দোকান, তবে সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূঁজা
অর্চনার কোন কিছু বিক্রয় হয়না ,বিক্রয় হয় খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের
নবী যীশু খ্রীষ্ট ও মাতা মারিয়ুম এর মূর্তি,বাইবেল এবং খ্রীষ্ট
ধর্ম সংক্রান্ত বই ইত্যাদি।
হাসনাত
আপা কিছু সুভেনির কেনার ইচ্ছে পোষন করলেন তাই উ্জ্জ্বল ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন আশেপাশের
একটি পরিচিত বাঙ্গালী মালিকের সুভেনিরের দোকানে।দোকানটি অনেক বড় এবং সাজানো গোছানো ।বার্সেলোনা শহরে এত সুন্দর একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক একজন বাংলাদেশী ভেবে গর্ববোধ হলো।উজ্জ্বল ভাই সবাইকে দোকানের স্বত্বাধিকারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।ভদ্র লোকের নাম উত্তম কুমার, বাংলাদেশের ফেনী জেলায় তার পৈতিক নিবাস।নব্বই দশকে ফ্রান্সের প্যারিসে পাড়ি জমালেও পরবর্তিতে স্পেনের এই বার্সেলোনা শহরে থিতু হয়েছেন।অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের সাংস্কৃতিক মনা মানুষটি স্বপরিবারের এখানে বসবাস করছেন।আমরা যে বাংলাদেশ সমিতির আয়োজনে বৈশাখী মেলা উপলক্ষ্যে এখানে এসেছি, উত্তম কুমার সেই বাংলাদেশ সমিতি বার্সেলোনার সাধারণ সম্পাদক।হাসনাত আপা ওনার দোকান থেকে ক্রয় করার জন্য যে সুভেনিরগুলো সংগ্রহ করলেন কিন্তু মূল্য দিতে গিয়ে শত চেষ্টা করেও দেয়া সম্ভব হলোনা।আমাদের অন্যাদেরকেও একটি করে সুভেনির উপহার দিলেন।হঠাৎ দোকানের দেয়ালের এক পাশে ছেঁটে দেয়া একটি পোষ্টারে নজর পড়লো।২৯ মে অনুষ্ঠিতব্য বৈশাখী মেলার পোষ্টার ,পোষ্টারটি চারজন গুনি অতিথি শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন,তপন চৌধুরী,পবন দাস বাউল ও আমাদের কাব্য কামরুলের ছবি সম্বলিত। ভালো লাগলো পোষ্টারে কাব্য কামরুলের ছবি দেখে।
উত্তম দা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম সাগর পারের উদ্দেশ্যে।প্লাসা দো কাতালোনিয়া থেকে সহজ পথ লা রামলা দিয়ে আমরা সাগরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।পর্যটকদের শ্রোতে লা রামলা’র প্রশস্থ পথটি যেন একটি দীর্ঘ মৌন মিছিলের রূপ নিয়েছে।উজ্জ্বল ভাই প্রথমেই লা রামলার পাশেই অবস্থিত বার্সেলোনার একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার ‘মার্কা সেন্ট যোসেফ লা বুকারিয়া’ (Mercat St. Josef La Boqueria)তে নিয়ে গেলেন।কয়েক শত বছরের প্রাচীন এই বাজারটিতে যতটানা ক্রেতার ভীড় রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুন রয়েছে দর্শনার্থীদের হুড়োহুড়ি।বাজারটির ধরণ আমাদের দেশের কাওরান বাজারের মত কিন্তু অত বড় নয়।এই ছোট্ট বাজারটিতে মাছ,মাংশ,ফলমূল,শাক সবজি,রেস্তোরার খাবার সবই পাওয়া যায়।আমাদের দেশের বাজারগুলো থেকে পার্থক্য এই যে,বাজারটি চকচকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং প্রতিটি দোকানের পন্য সামগ্রী এমন বৈচিত্র ও শৈল্পিকভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রদর্শিত যা যে কোন মানুষকেই আকৃষ্ট করবে।শৌখিন আলোকচিত্রিরা তাই এই ব্যতিক্রমধর্মী দোকানগুলোর ছবি তুলতে সদা ব্যস্ত।লা বুকারিয়া থেকে বেরিয়ে আমরা আবার মিরাদোর দো কলম(Mirador de colom)দিকে হাঁটতে লাগলাম। লা রামলার ব্যস্ত লোকারণ্য পথটির দুই ধার দিয়ে সুসজ্জিত সুভেনিরের দোকান, চিত্র শিল্পীদের চিত্রকর্মের ব্যস্ততা,পথ শিল্পীদের নাবিক কলম্বাস,বিখ্যাত স্থপতি গাউদির মূর্তি সেজে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার দৃশ্যগুলো যেন জায়গাটিকে এক ভিন্নতর সৌন্দর্য দিয়েছে। এই সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কাব্য ভাই কয়েকবার আমাদের মাঝ থেকে পর্যটকদের ভিড়ে হারিয়ে গেলেন। আমিও ছবি তুলতে গিয়ে গ্রুপ থেকে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম।
প্রচন্ড রোদ আর রাতভর দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি সবার মধ্যে ভর করে বসলো , তাই মিরাদোর দো কলম এ আসার পর কেউ আর সামনে এগুতে ইচ্ছে পোষন করলো না।সবাই এই বন্দরের গাছের নিচে জল খাবার নিয়ে বসে পড়লাম।আমাদের ক্ষুদে ভ্রমণার্থী আঞ্জু আর ফিরোজাও এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলো।গল্প গুজবের ফাঁকে আমাদের পুঁথি শিল্পী কাব্য ভাই বার্সেলোনা শহর নিয়ে একটি পুঁথিও রচনা করে ফেললেন। তাৎক্ষনিক রচিত সেই পুঁথি আবার পোর্ট ভেল বন্দর পাড়ে উজ্জ্বল ভাইয়ের নির্দেশনায়
মোবাইল ক্যামেরায় শ্যুট করা হলো।ব্যতিক্রম সুরের এই পরিবেশনা দেখে কিছু সাদা চামড়ার মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকলেন।সঙ্গে সঙ্গে এই বন্দর পাড়
থেকে বার্সেলোনা বন্দনার এই পুঁথি’র ভিডিওটি ফেজবুকে আপলোড করে বার্সেলোনা প্রবাসী বাঙ্গালীদের জানিয়ে দেওয়া হলো পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুলের আগমন বার্তা।
মিরাদোর কলম , এই বন্দর থেকেই নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম আবিস্কারের উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রা করেন।এখানে রয়েছে নাবিক কলম্বাসের স্মৃতিসম্বলিত যাদুঘর কলম মুজে মারিতিম(COLOM MUSEU MARITIM)।
মিরাদোর কলমে বিরতির পর মল দোলা ফুজতা(Moll de la Fusta)দিয়ে সমুদ্র সৈকতের দিকে যাওয়ার সময় সুসজ্জিত সারি সারি পাম গাছ দেখে মনে হলো আমরা যেন কোন এক মরূদ্যানের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলছি।পাশেই বন্দরে নোঙ্গর করা ছোট বড় জাহাজগুলো ভূমধ্যসাগরের বুকে ভেসে বেড়াতে অপেক্ষমান।বন্দর পার দিয়ে আফ্রিকান কালো মানুষদের বার্সেলোনা ক্লাবের সেরা তারকা মেসি ও নেইমারদের জার্সি,সানগ্লাসের ভ্রাম্যমান দোকানগুলোর কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের ভেতর দিয়ে ক্যাপ দো বার্সেলোনায় আসার পর একটি রেস্তোরায় উজ্জ্বল ভাইয়ের আতিথেয়তায় আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের পর্ব শেষ হলো।খারার মেন্যুতে ছিলো আমার পছন্দের তার্কিশ কাবাব , যা প্যারিসে অনেক খেয়েছি কিন্তু বার্সেলোনায় এসে পেলাম একই খাবারের অতুলনীয় ব্যতিক্রম স্বাদ এবং পরিবেশনের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতার ছোঁয়া।
আমরা এখান থেকে একটি আবাসিক এলাকার মধ্যদিয়ে হেঁটে সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার সময় চোখে মিললো প্রতিটি বিল্ডিংয়ের
বেলকুনিগুলোতে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব ও কাতালোনিয়া অঙ্গ রাজ্যের বৈজয়ন্তী টাঙ্গানো। এ থেকেই মনে হলো এই শহরের মানুষের ফুটবল
নিয়ে রয়েছে অফুরন্ত উচ্ছাস উন্মাদনা এবং ভালোবাসা,আর কাতালানদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন কাতালোনিয়া রাষ্ট্র
নিয়ে যে স্বপ্নের লালন চলছে, এই পতাকাগুলো জানিয়ে দিলো তারই প্রতি অসীম মমত্বের বহিঃপ্রকাশ।
লা বার্সেলোনতা সমুদ্র সৈকতটি পর্যটকদের সামগ্রীক সুবিধার কথা চিন্তা করে
স্থানীয় প্রশাসন সু-পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে রেখেছে। সাগর পারের বেলাভূমিতে পৃথিবীর নানা দেশ
থেকে আসা শত শত নারী পুরুষ এবং শিশু কিশোরদের নানাবিধ কর্মকান্ডে
যেন সৈকতটি এক পর্যটক মেলায় পরিণত হয়েছে।কেও স্বল্প বসনে প্রখর রোদ্রের মধ্যে শুয়ে
আছে,কেউ ব্যায়াময়ের
সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো স্থানে ব্যায়াম করছে,কেউ সাগর জলে শরীর ভেজাচ্ছে,
কেউবা ছুটোছুটিতে মগ্ন। দূরে বিশাল জলরাশির মধ্যদিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে
নানা আকৃতির ছোট বড় পর্যটন জাহাজ।পোষাকের প্রস্তুতি না থাকায় আমাদের মধ্যে কেউই সৈকতের বেলা ভূমিতে হেঁটে বেড়ানো
বা ভূমধ্যসাগরের জল ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে পোষন করলোনা। সাগর পাড়ের বিশ্রাম চেয়ারে গল্প করেই আমাদের
অধিকাংশ সময় কাটলো।সৈকতের পাড় দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে নানা স্থাপনা ও সড়ক।সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য দাড়িয়ে আছে সারি সারি পাম গাছ ,গাছের সারির পাশ তৈরি করা হয়েছে আরো একটি ছোট্ট পরিসরের রাস্তা, তা শুধুই সাইকেল আরোহীদের জন্য ,সেই রাস্তা দিয়ে সাগরের উন্মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ক্রমাগত ছুটে চলছে নানা আকৃতির দ্বিচক্রযান চালিত শত শত আরোহী। স্পেনের বার্সেলোনা একটি সাইকেল বান্ধব
শহর।শুধু এই সমুদ্র পারেই নয় ,এই শহরের আনাচে কানাচে এমন সাইকেল চালানোর
দৃশ্য সব সময় দেখা মেলে।তবে অধিকাংশ সাইকেলগুলো ব্যক্তিগত নয়, এগুলো বিভিন্ন সাইকেল ভাড়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভাড়া দেওয়া
হয়।এই সাইকেলগুলো চালাতে হলে মাসিক বা বাৎসরিক চাঁদার বিনিময়ে
সদস্য হতে হয়।সদস্য হলে তারা একটি ইলেকট্রনিক্স কার্ড দেয় ।এই কার্ড দিয়ে ইচ্ছে মত
যে কোনো গ্যারেজের ছোট্ট খুটির সাথে লক করা সাইকেলগুলো থেকে কার্ড পাঞ্চ করে একটি
সাইকেল তুলে ইচ্ছে মত চালোনো যায়,আবার অন্য যে কোন গ্যারেজে রেখে দেওয়া যায়।
আমাদের ক্ষুদে ভ্রমণসঙ্গী আঞ্জু তিনমাস আগে এই সাগর পাড়ের ডেল
মার হসপিটালে জন্মগ্রহন করেছে।হসপিটাল সম্পর্কে আলোচনা করতে উজ্জ্বল ভাই জানালো এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থার এক ব্যতিক্রমধর্মী
কৌশলের কথা।এখানকার চিকিৎসকেরা শুধু চিকিৎসা বিদ্যা দিয়ে মুমূর্ষু রোগীর শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গের চিকিৎসাই করেনা ,স্বপ্রণদিত হয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মানুসিক ভাবে ভেঙ্গেপরা মানুষদের মনের উৎফুল্লতার দায়িত্বও নিয়ে থাকেন।তাই হসপিটালের চিকিৎসক ও সেবিকারা যখন রোগী পরিদর্শনে বের হয় তখন তাদের পেশাগত পোষাকের পাশাপাশি মাঝে মাঝে রোগীর সামনে বৈচিত্রময় কমেডিয়ান পোষাক পড়ে হাজির হন এবং রোগীকে চমকে দিয়ে দুঃচিন্তাগ্রন্থ মনকে প্রফুল্লতায় ভরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।বিষয়টি জেনে আশ্চর্য হলাম এবং ভালো লাগলো রোগীর প্রতি চিকিৎসকদের এমন মমত্ব ও ভালোবাসা প্রকাশের ব্যতিক্রম উদ্ভাবনে।
আমাদের সবার শরীর বিশ্রামের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, তাই আজ আর অন্য কোথাও ঘোরার ইচ্ছে হলোনা।সৈকত থেকে আমরা বাসে চলে এলাম প্লাসা ম্যাকবা অর্থাৎ উজ্জ্বল ভাইয়ের বাসার এলাকাতে।এখানে পরিচয় হলো বৈশাখী মেলা আয়োজকদের অন্যতম সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব শফিক খানের সাথে।তিনিও এক সময় প্যারিসে থাকতেন কিন্তু পরবর্তীতে এই সাগর পাড়ের শহরে থিতু হয়েছেন।এখানে একটি বাঙ্গালী টেইলার্সের দোকানে কয়েকজন স্থানীয় প্রবাসী বাঙ্গালীদের সাথে পরিচয় হলো।কেউ একজন আমাদের জন্য মুঠোফোনে চায়ের অর্ডার করলেন ,কিছুক্ষণের মধ্যে এক বাঙ্গালী প্রবাসী ভাই চায়ের কেটলি নিয়ে হাজির হলেন ,চায়ের স্বাদ পুরোপুরি বাংলার গ্রাম্য হাট বাজারের ঝুপড়ী চায়ের দোকানের খাঁটি দুধের চায়ের মত।কিন্তু এই চা বিক্রেতা ভাইয়ের এখানে কোন স্থায়ী চায়ের দোকান নেই।প্লাসা মাগবার আসে পাশে মূলত আমাদের দক্ষিন এশিয়া ও অন্যদের দেশের প্রবাসীদের বসবাস।পরিবেশটাও গড়ে উঠেছে আমাদের অঞ্চলের দেশগুলোর মত। রয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশী ,পাকিস্থানী এবং ইন্ডিয়ানদের দোকানপাট।এইসব দোকানগুলোতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে প্রবাসীদের আড্ডা ,সেই আড্ডায় খোশ গল্পগুজবের পাশাপাশী চলে চা চক্র।এই আড্ডা স্থলগুলো থেকে ঐ চা বিক্রেতা ভাইকে ফোন করামাত্র তিনি চায়ের কেটলি হাতে হাজির হয়ে চা পরিবেশনের মাধ্যমে
আড্ডাকে আরো প্রাণবন্ত করতে ভূমিকা রেখে থাকেন।আর এটাই তার সুদূর প্রবাসের জীবীকা।
এখান থেকে আমরা চলে গেলাম বৈশাখী মেলার প্রস্তুতি ও মহড়া স্থলে।দেখা হলো আমাদের প্যারিসের প্রিয়,পরিচিত ও সদা হাস্যজ্জল
মুখ চিত্রশিল্পী মুহিদ জ্যেতির সাথে।বৈশাখী আয়োজনের নানা প্রকার শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে
খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি।কাজের ফাঁকে অনেক রমনীর অনুরোধে তাদের পোর্টরেট
ছবি এঁকে দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেকের বেশ
প্রিয়ও হয়ে উঠেছেন তিনি।এই রিহার্সাল স্থলের পরিবেশটা অনেকটা ঈদের
চাঁন রাতের মত আনন্দঘন অবস্থা বিরাজ করছে।ইতোমধ্যে আমন্ত্রিত প্রধান শিল্পীদের মধ্যে সঙ্গীতশিল্পী তপন চৌধুরী বার্সেলোনায় অবস্থান করছে।আর আমাদের সাথেই রয়েছেন পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুল।স্থানীয় সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পীরা
যুক্তরাজ্য থেকে আগত যন্ত্র শিল্পীদের বাদ্যযন্ত্রের সুরের তালে মহড়ায় ব্যস্ত।দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতির প্রদর্শন
হবে আগামীকালের প্লাসা ম্যাকবার বৈশাখী মঞ্চে,তাই স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের সহযোগীতায় ছুটোছুটির
মধ্যে আছে।আয়োজক নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানের সার্বিক সাফল্যের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন
ও বাস্তবায়নে সদা কাজ করে চলেছেন।রাত এগারোটার দিকে প্যারিস থেকে বিমানে উড়ে এলেন পবন দাস বাউল দম্পতি।রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহড়া স্থল বৈশাখী আয়োজনের সমস্ত প্রস্তুতির যবনিকা টানতে লাগলো।এবার অথিতিদের রাত্রি যাপন ও রাতের খাবারের বন্দবস্থ করতে আয়োজকরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
আমাকে এবং পবন দাস বাউল মিমলু সেন দম্পতিকে হোটেলে তুলে দেত্তয়ার জন্য আয়োজক নেতৃবৃন্দের একজনের সঙ্গে করে
মহড়া স্থল থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।ট্রাক্সি করে হোটেলে যাওয়ার সময় পবন দাস বাউলের
সঙ্গে তার গান,দর্শন এবং বাংলাদেশে তার গানের জনপ্রিয়তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশ আলাপ জমে উঠলো।২০০৬ সাল, তখন
ঢাকায় ধানমন্ডির একটি ফ্লাটে আমরা সাত আট জন ব্যাচেলর মেছ করে থাকি।মাঝে মাঝেই
আমাদের মেছে রাতে বিশেষ আড্ডা জমে উঠতো,বাইরে থেকে দু একজন বন্ধু যোগ
দিতো সেই আড্ডায়।আমাদের সেই আড্ডায় মাঝে মাঝেই পবন দাস বাউলের ঐ সময়ের জনপ্রিয়
একটি গান « বসুন্ধরার বুকে বরষারই
ধারা »বেশ গাওয়া হতো।ভালোই লাগলো
সেই গানের স্রষ্টার সাথে ক্ষণিকের সান্নিধ্য। একই শহরে বসবাস করলেও পূর্বে তার সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎতের সুযোগ হয়নি।পবন দাস বাউল ও মিমলু
সেন দম্পতিকে হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে এবার
আমাকে রাতের খাবারের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো ভিলাদোমাত(viladomat) রোড়ে অবস্থিত পিজারিয়া বার্গার রেস্তোরায়। রেস্তোরায়
আসার সময় বার্সেলোনা শহরের রাতে বেশ কিছু চিত্র ধরা পড়লো। মধ্যরাতের
পর সাধারণত যে কোন শহর নিস্তব্ধ হয়ে যায়, বিশেষ করে প্যারিস শহরে সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ নিরবতা নেমে আসে, অন্য
কারো অসুবিধা অনুভব হবে ভেবে কেউ উঁচু স্বরে কথা পর্যন্ত বলেনা,রাত্রে উচ্চ শব্দের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইনও রয়েছে। কিন্তু বার্সেলোনায় দেখা মিললো মধ্য রাত থেকে
এই শহরের নতুন রূপে জেগে ওঠার চিত্র।রাস্তার পাশের ওলিগলীগুলোতে চলছে তরুন তরুনীদের
আড্ডা ও হইহুল্লোর।রেস্তোরাগুলো জেগে আছে ভোজন রসিকদের রসনার তৃপ্তি
মেটাতে।ঐদিন ঐ সময়ে চলছিলো এ্যাটলেতিকো মাদ্রিদ ও রিয়াল মাদ্রিদের মধ্য
একটি ফুটবল ম্যাচ,ম্যাচের উত্তেজনাপূর্ণ মূহুর্তগুলোর আনন্দ উচ্ছায়
বিনিময় চলছে এক ফ্লাটের জালানা খুলে অন্য ফ্লাটের সমর্থকদের সাথে।এমন ফুটবল
উন্মাদনা দেখে মনে হলো এই শহরকে ফুটবলের তীর্থ
ভূমি বললে ভুল হবেনা।এছাড়া বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল ক্লাব ‘বার্সেলোনা’তো এই শহরেরই অহংকারের ধন।
রেস্তোরায় কাব্য কামরুল দম্পতি আমার জন্য অপেক্ষা করে ইতোমধ্যে
খাওয়া শুরু করেদিয়েছে।তাদেরকে অতি মমতায় আতিথেয়তা করছেন পিজারিয়া বার্গার
রেস্তোরার মালিক এম ডি আওয়াল ইসলাম এবং তার সহধর্মীনি জাহানারা বেগম।আমিও যোগ
দিলাম তাদের সাথে। খাবারের মেন্যুতে রয়েছে সালচা(আলুর
ফ্রাই),পিজ্জা ,মূল খাবার
আমাদের দেশের খিচুরি সদৃশ পায়লা(Paella)।খিচুরি ভেবেই
থালা ভরে পায়লা তুলে নিলাম কিন্তু একটু ভালো ভাবে দেখে খেতে গিয়ে হোঁচট খেলাম,কারন খাবারটির মধ্যে
অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে ঝিনুক, অক্টোপাস এবং চিংড়ি মাছ।ফরাসিদের
অতি প্রিয় খাবার ঝিনুক হলেও দীর্ঘদিন এই ভূখন্ডে বাস করেও রান্না ঝিনুকের স্বাদের সঙ্গে
পরিচিত হইনি আমাদের দেশে এই খাবারটি না খাওয়ার অভ্যাসগত কারণে।চিংড়ি আমার
অতি প্রিয় খাবার কিন্তু ঝিনুক ও অক্টোপাসের কারণে কিছুক্ষনের জন্য দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম খাওয়া না খাওয়া নিয়ে।একবার ঢাকায় গুলশানের একটি রেস্তোরায় অফিসিয়াল পার্টিতে কৌতুহলবসত কাঁকড়া খেতে গিয়ে পরে খেতে
পারিনি, যা আমাদের দেশের অনেক মানুষই খায়।সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের
ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে।এই ভেবে
খাওয়া শুরু করলাম।ঝিনুক ও অক্টোপাসের স্বাদ চিংড়ি মাছ থেকে খুব একটা ব্যতিক্রম
মনে হলো না।বেশ তৃপ্তিসহকারে নিলাম বার্সেলোনার ঐতিহ্যবাহী খাবার পায়লার স্বাদ।
খাবার পর্ব শেষ করে হোটেলে পৌঁছুতে প্রায় রাত দুইটা বেজে গেলো।হোটেলে পৌঁছানোর সাথে সাথে অবসন্ন শরীর আর জেগে থাকার সময় দিলোনা , মুহূর্তের মধ্যে চলে গেলাম গভীর ঘুমে। আমি যে হোটেলটিতে ছিলান সেটি বাংলাদেশ সমিতি বার্সেলোনার সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমারের মালিকানাধীন এবং তার সৌজন্যে।
যে মানুষটি খাবারের ব্যবস্থা ও রাত্রি যাপনের
স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাকে সাথে নিয়ে টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্য
সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহে মধ্যরাতের বার্সেলোনা শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন তার নাম ‘সহজ’। প্রথম যখন
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনার নাম কি ?উত্তরে, আমার নাম সহজ বলে থেমে গেলেন।আমি আবার
তাকে জিজ্ঞেস করলাম সহজ কি ?উনি বললেন
আমার নামই সহজ।তখন বুজলাম কোন মানুষের নাম সহজও হতে পারে।তবে মাদারীপুরের
সহজ ভাইয়ের সঙ্গে যতটুকু মেশার সুযোগ হয়েছে তাতে তাকে একটুও জটিল মনে হয়নি,তার নামের
মতই স্বভাবেও খুবই সহজ , বন্ধুসুলভ
এবং অতিথিপরায়ণ মানুষ মনে হয়েছে।
১.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-১) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
২.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-২) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৩.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-৩) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৪.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-৪)পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৫.বৈশাখের আমন্ত্রণে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা ঘুরে এসে (পর্ব-৫) পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন