বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যে বর্ষার আসে এক অনন্য সাজ সজ্জায়। বর্ষার সাথে বাঙালী মনের এক দারুণ সংযোগ।বর্ষা মানে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে হৃদয়ে শিহরণ জাগা।বর্ষা শব্দটি শুনলে, চোখে ভেসে ওঠে থোকা থোকা ফোটা কদম ফুলের শুভ্র প্রকৃতি,যৌবন ফিরে পাওয়া নদীর বুকে ঢেউয়ের খেলা, জলে টৈটুম্বর খাল বিল, বাদল ঝরা দিনের অলস সময়ে বন্ধুদের তাসের আড্ডা অথবা অজপাড়া গায়ের বৃষ্টি ভেজা মাঠে দুরন্ত ছেলেদের ফুটবল খেলার দৃশ্য।আষাঢ়ের ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি দেখলেই মন চায় ভাপ ওঠা সর্ষে ইলিশের গন্ধে প্রাণ জুড়িয়ে জিহ্বার তৃপ্তি মেটাতে।
বাংলার বর্ষা মানেই একাকী নির্জনে রবীন্দ্র সুরে বুঁদ হয়ে প্রথম প্রেমে পড়া প্রিয় মানুষের স্মৃতি রোমন্থন অথবা দূরে চলে যাওয়া মনের মানুষের বিরহ ব্যথায় কাতর হওয়া।আবার, হাসনাহেনা, গন্ধরাজের সুবাসিত সন্ধ্যায় দেহ মন সজীব হয়ে ওঠা। আষাঢ় শুধু নিজেই বারি ঝরিয়ে শুষ্ক প্রকৃতির প্রাণ ফিরিয়ে আনে না,বাংলার প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়কেও রসসিক্ত করে তোলে,প্রেমের অনুভূতিগুলো নতুন রূপে ডালপালা মেলে দেয়।হৃদয় হয়ে ওঠে কাব্যময়। তাইতো বর্ষা, বৃষ্টি ও শ্রাবণ নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র কবিতা গান,যা সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে।বর্ষা যেন বাংলার প্রকৃতিতে ঈশ্বরের বিশেষ উপহার।
বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যে প্রতিটি ঋতু সুশৃঙ্খলিত। বিশেষ রঙ, রস, রূপ,গন্ধে প্রত্যেক ঋতু প্রতিটির থেকে আলাদা এবং স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। যেমন, চারিদিকে যখন প্রচণ্ড তাপদাহ,মাটি ফেটে চৌচির,মানুষ একটু শীতলতার খোঁজে গাছের ছায়া খুঁজে ফেরে,ঘাম ঝরা প্রকৃতিকে শান্ত করতে আকাশে মেঘের গুরুগর্জন ডাক ছেড়ে আষাঢ়ের আগমন ঘটে,ঝুম ঝুম বারি ঝরিয়ে প্রশান্তির পরশ এনে দেয় চারিধারে।অঙ্কুরিত হওয়ার উন্মুখ প্রতীক্ষায় থাকা উদ্ভিদ বীজ মাটি ফুঁড়ে পাতা ছড়িয়ে বেড়িয়ে আসে।খাল বিলে বয়ে যায় মাছের দলের আনন্দধারা।
প্রবাস জীবনে বাংলার বাদল ঝরা প্রকৃত বর্ষার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।ফরাসি ঋতু পরিক্রমায় বর্ষা নামে কোন ঋতু নেই।কিন্তু এখানেও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরে, কখনো আচমকা প্রবল বৃষ্টির ধারা এসে ধুয়ে দিয়ে যায় চারিপাশ। কিন্তু এই বৃষ্টি নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস নেই ফরাসিদের মধ্যে, বরং বৃষ্টি জেনো ফরাসি জনগোষ্ঠীর মনে গভীর বিষণ্ণতা বয়ে আনে, বিরক্তির প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে প্রত্যেকের মুখে। ফরাসি সাহিত্যেও মর্যাদা পায়নি বৃষ্টি বাদল। এখানকার জীবনধারার অধিকাংশ সময় কাটে মেঘঢাকা হিমশীতল প্রকৃতির মাঝে।শৃঙ্খলহীন গোমড়ামুখো আকাশ যখন তখন এই ঠাণ্ডা প্রকৃতির মাঝে ঝিরি বৃষ্টি ঝরিয়ে বিষণ্ণ মনের নিরানন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে।ফলে বর্ষা বাদল মুক্ত একটি আলো ঝলমল রোদেলা দিনের অপেক্ষা থাকে প্রতিটি ফরাসির মন।তাই, বৃষ্টির সৌন্দর্য ফরাসি হৃদয়ে তেমন আঁচড় কাটতে পারেনা। কিন্তু আমাদের প্রবাসী বাঙ্গালী চোখ কখন এক পশলা বৃষ্টি ঝরার দৃশ্য দেখলে বাংলার আষাঢ় শ্রাবণ ভেবে আনন্দে শিহরিত হয়। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শুনলে স্মৃতিকাতর হয়ে কল্পনার ডানায় পাখা মেলে মন চলে যায় গ্রামের কোন টিনের চালা ঘরে।
বাংলার ঋতু পরিক্রমায় এখন চলছে বর্ষা কাল।ঝরছে আষাঢ়ের বাদল। প্রকৃতি জেগে উঠেছে বর্ষার সৌন্দর্যে কিন্তু প্রাণের উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিয়েছে করোনা মহামারী।যে প্রাণ বৃষ্টির ছন্দে নেচে উঠবে, সেই প্রাণে আজ মৃত্যু ভয়।ইতোমধ্যে সারা বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় আঠারোশ মানুষ। প্রত্যাশা, বর্ষার জলের ধারা যেমন ময়লা আবর্জনা ধুয়ে মুছে প্রকৃতিকে উপহার দেয় নতুন এক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারিধার , তেমনি আমাদের একে ওপরের চেষ্টা ও সহযোগিতায় অতিশিগ্রই করোনামুক্ত হয়ে আবার জেগে উঠবে নতুন এক উদ্যমী বাংলাদেশ।আবার বৃষ্টি বাদলের ছন্দ ঢেউ জাগাবে প্রতিটি বাঙ্গালী প্রাণে।
বাংলার বর্ষা, প্রবাসী মন ও করোনাকাল / প্রথম আলো
বাংলার বর্ষা, প্রবাসী মন ও করোনাকাল / প্রথম আলো
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন