সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

যেমন কর্ম, ফল সবসময় তেমন নয়

সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা জানি, কোন ক্রিয়ার কারণে প্রতিক্রিয়া হয়,প্রতিক্রিয়ার কারণে ক্রিয়া তৈরি হয়। অর্থাৎ, কোন ঘটনার পেছনে অবশ্যই কোন কারণ থাকবে, আমাদের চোখের সামনে যখন একটি ঘটনা এসে দাঁড়ায়,তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা উত্তর খুঁজি, ঘটনাটা কেন ঘটেছে?এবং এটাই যৌক্তিকতা।কিন্তু এই পৃথিবীতে অহরহই অনেক ঘটনা ঘটে যা কারণ ছাড়াই। এটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু , কোন  ঘটনা  কারণ ছাড়াও ঘটতে পারে,কোনকিছু না করেও কেউ বড়  অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে, এমনকি দোষী হিসেবে প্রমাণিত হয়ে শাস্তি ভোগ করতে পারে,  এভাবে আমরা অধিকাংশ মানুষ  বিচার,বিবেচনা ও ভেবে অভ্যস্ত নই। 


বাস্তব জীবনে কোন ঘটনা না ঘটিয়ে বা কোন ঘটনার সাথে যুক্ত না থেকে কোন দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অভিযুক্ত  যে ব্যক্তি হয়নি তার পক্ষে এই  উপলব্ধি করা দুরূহ কঠিন।  

 

আমরা সাধারণ চোখ দিয়ে যা কিছু দেখি এবং কান দিয়ে  শুনে বিশ্বাস করি তার অনেক কিছুই শতভাগ মিথ্যা।কারণ, ঘটনার মূলে গিয়ে বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণের সময় ও ইচ্ছে আমাদের অধিকাংশ মানুষের থাকে না বলেই অনেক সময় মিথ্যাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে থাকি।       


আমরা একটা প্রবাদ শুনে থাকি «  যেমন কর্ম তেমন ফল » প্রবাদটি যুক্তিযুক্ত হলেও  শতভাগ যৌক্তিক  নয়।এই পৃথিবীতে সব ফলই কর্ম দ্বারা নির্ধারিত হয়না।কখনো কখনো আমাদের জীবনে এমন কিছু অদ্ভুদ ঘটনা ঘটে যে আমরা হতবম্ব হয়ে যাই।দেখা যায়, কর্মই করা হয়নি অথচ বিদঘুটে ফলাফল আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। আমরা অবাক হই,হতবাগ হই,এক সময় উত্তরণ লাভ করি, কিন্তু অদৃশ্য ঝড়ে  ধ্বংস হওয়া জীবনের সাজানো গোছানো স্তম্ভগুলোকে আবার সোজা করে দাড় করাতে অনেক বেগ পোহাতে হয়, অনেক সময়  ছোট্ট জীবনের মূল্যবান অনেক  সময় অতিবাহিত হয়ে যায় হতাশার মধ্যদিয়ে ।আপনি জীবনে চুরি করবেন না, অন্যের উপর অন্যায় আচরণ করবেন না বলে ব্রত নিয়েছেন, যাতে এই সমাজে আমৃত্যু  সৎ মানুষের পরিচয়ে বাঁচতে  পারেন।আপনার ব্রত অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলেও আপনি যে এমন জীবন পাবেন তার নিশ্চয়তা এই পৃথিবীতে শতভাগ নেই।আমাদের প্রত্যেককে  ঘিরে আমাদের কর্মজীবন ও সমাজ সংসারে অনেক মানুষ আবর্তিত হয় ।এই মানুষগুলোর মধ্যে কেউ সৎ,কেউ অসৎ, কেউ প্রচণ্ড স্বার্থপর, কেউ প্রচণ্ড উদার,কেউ বিশ্বাসী ,কেউ সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত, যাদের উপর নির্ভর করে আমাদের জীবনের উন্নতি অবনতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই মানুষগুলোর কারণে প্রত্যাশার চেয়ে জীবনে অনেক বড় ইতিবাচক প্রাপ্তি আসতে পারে। আবার, এই মানুষগুলোর কারণে খুন না করেও সারা জীবন খুনের আসামী হয়ে কারাগারে জীবন পার হতে পারে ।আপনি খুন করেনি অথচ মানুষ জানবে আপনি একজন খুনি। যা আপনার কর্মফল নয়।  


 

দেশের আইন আদালতের রায় অনুযায়ী সাব্যস্ত কোন মানুষকে আমরা  অপরাধী আবার নিপরাধী বলে থাকি। অনেক তদন্ত,সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে এই রায় দেয়া হয় বলেই আমাদের এই আস্থা বা বিশ্বাস।অথচ অন্যায় না করেও এই আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জীবনটাই বলি হয়ে যায়  অনেক মানুষের। যা আমাদের দেশসহ সারা পৃথিবীতেই এমন ঘটনা চলমান।  

বাংলাদেশে অপরাধ না করেও বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে যাদের


কোন ঘটনা দেখা ও শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মন্তব্য ও বিচার করার যে সহজাত প্রবণতা রয়েছে তা পরিবর্তন আনা জরুরি।কারো প্রতি কোন মন্তব্য ছুড়ে দেবার পূর্বে অন্তত একবার ভাবা উচিত যে আমার একটি মন্তব্য অন্যের জীবন ও কর্মে উপর উপর প্রভাব বিস্তার করবে।যে প্রভাবে কারো জীবনের গতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। মন্তব্য অবশ্যই করবো তবে তা হতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন…… 

রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২১

কটাক্ষের কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পরাজয় ।

বাংলাদেশের ক্রিকেট আমাদের গর্বের জায়গা।ক্রীড়া ক্ষেত্রে  গর্ব করার মতো অনেকে কিছু দিয়েছে আমাদের ক্রিকেট।অনেক মেধাবী ক্রিকেটারের শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা জড়িয়ে রয়েছে আজকের এই অবস্থানের পেছনে। ক্রিকেটের এই  অগ্রগতিকে কেন্দ্র করে দেশের যুব সমাজের বিশাল অংশ আজ ক্রীড়ামুখী, খেলাকে নিয়ে অনেক তরুণ আজ জীবন গড়ার স্বপ্নও দেখে । এই ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফলে সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান।সুস্থ জাতি গঠনে ক্রীড়ার ভূমিকা অপরিসীম।একমাত্র  ক্রিকেটই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে গর্বের সহিত আমাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই ক্রিকেটের  উন্নতির স্বার্থে  ক্রিকেটারদের প্রতি আমাদের সমর্থন ও উৎসাহ গুরুত্বপূর্ণ।  


জাতিগত মানসিকতায় আমরা সবকিছু তাৎক্ষনিক চাই, কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য সাধনা এবং ধৈর্য ধারণ করতে অভ্যস্ত নই।যেটা জানিনা বা পারিনা সে বিষয়েও পাণ্ডিত্য করতে আমাদের জুরি নেই। আমরা বুঝতে চেষ্টা করিনা, যে কাজটি করে তার কাজের চেষ্টা ও পরিশ্রমের কষ্ট।দূর থেকে নিজের মত একটা মন্তব্য করেই মনে করি বিশাল কাজ করে ফেলেছি। আমার একটি মন্তব্য অন্যের জীবন ও কর্মে উপর কতটা  প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা ভাবার সময় হয় হয় না কখনো। 


চলমান টি টোয়েন্টি  বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স নিয়ে চলছে দারুণ সমালোচনার ঝড়।আমার কাছে মনে হয়েছে দারুণ একটি প্রতিভা সম্পন্ন দল এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছে। যে দলটি দেশের মাটিতে এই ফরম্যাটের খেলায় অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড সাথে সিরিজ জিতে মানিসিক শক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে এই বিশ্বকাপ মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। আমরা টেস্ট প্লেয়িং দেশ,ক্রিকেট মান মর্যাদায় অন্যদের থেকে উপরে তাই দলের প্রতি আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। ধরেই নেই আমাদের সাথে আইসিসি’র কোন সহযোগী সদস্য দেশ জিততে পারবে না।মনে রাখতে হবে,১৯৯৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত  আমরা আইসিসি’র সহযোগী সদস্য ছিলাম।এতো বছর পার হলেও অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের মতো দল এখনো বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কোন সিরিজ খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করেনা না। আমরা দেখেছি সদ্য সমাপ্ত অস্ট্রেলিয়া দলকে বাংলাদেশে আনতে বিসিসিবি’কে কি পরিমাণ কসরত করতে হয়েছে।অস্ট্রেলিয়া টিম এবং তাদের সমর্থরা ধরেই নেই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা মানেই অস্ট্রেলিয়ার জয়।তাদের এই প্রত্যাশার  কারণ তাদের ধারাবাহিক এবং অতীতের সাফল্য।সেই অস্ট্রেলিয়া যখন বাংলাদেশ দলের কাছে এসে পাত্তা না পেয়ে সিরিজ হেরে যায় তখন তাদের খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের মানসিক অবস্থা কি ঘটে, একটু হৃদয় দিয়ে ভাবুনতো তবে এটাই ক্রিকেট এবং এটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য ।এই অনিশ্চয়তাই ক্রিকেটের আনন্দ। 

চলমান বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ দল হেরে যায় আইসিসি’র সহযোগী দেশ স্কটল্যান্ডের কাছে, অভিজ্ঞ তারকা সমৃদ্ধ দলের এমন পরাজয় মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়েছে।তবে এই পরাজয় অস্বাভাবিক নয় । দিনটি  স্কটল্যান্ডের ছিল বলেই এমন অঘটন ঘটেছে ।কিন্তু, আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি থেকে আরম্ভ করে সমর্থকরা  প্রথম দিনেই ক্রিকেটারদের প্রতি তীর্যক মন্তব্য করে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি।আমি মনে করি আমাদের এই তীর্যক মন্তব্যগুলোই আমাদেরকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে।  

আমরা যদি প্রথম রাউণ্ড থেকে বাদ পরতাম তাহলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না কারণ ওমান ক্রিকেট টিমের আমাদের সঙ্গে জেতার শক্তি সামর্থ্য ছিল, কিন্তু সৌভাগ্য তেমনটি ঘটেনি। আর যদি এমনটি হতো তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেট ধ্বংস হয়ে গেলো এমনটি  ভাবার যৌক্তিকতা নেই। 


যারা মাঠের খেলা খেলে আমাদের জন্য সুনাম বয়ে আনবে তাদের একটি পরাজয় দেখে যদি আমরা তাদেরকে মানসিক শক্তি না জুগিয়ে ভর্ৎসনা করি তাহলে তারা উজ্জীবিত হবে কিভাবে। শুধু শারীরিক শক্তি ও কৌশল জানা থাকলেই কোন যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়না,জয়ী হওয়ার জন্য সব চেয়ে বেশী দরকার মনোবল ও অন্যের অনুপ্রেরণা।কোন ব্যর্থতার সময় সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন অন্যের অনুপ্রেরণা, সেই অনুপ্রেরণার বদলে আমাদের বোর্ডকর্তা প্রথম ব্যর্থতায় দিনে ক্রিকেটারদের পাশে না থেকে ভর্ৎসনা উপহার দিয়েছেন।ফলে পরবর্তী ম্যাচগুলোতে টিমের প্রত্যেকটা খেলোয়াড় মাঠের পারফর্মেন্সের চাপের পাশাপাশি বোর্ড ও সমর্থকদের সমালোচনার চাপ মাথায় নিয়ে মাঠে নেমেছে।ফলে, অতিরিক্ত পেশারের কারণে প্রত্যেকটা খেলোয়াড় তার সহজাত খেলাটা হারিয়ে ফেলেছে।একজন খেলোয়াড় কিভাবে ব্যাট চালাবে, কিভাবে বল করবে সে সিদ্ধান্ত ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করবে একজন খেলোয়াড়, কখনো পরামর্শ থাকবে অধিনায়ক ও দলের কোচের।  

একজন ক্রিকেটার তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও খেলোয়াড়ি শিক্ষা মাঠে প্রয়োগের ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কখনো সফল হন, কখন ভুল সিদ্ধান্তে  ব্যর্থ হন।কিন্তু তার চেষ্টা ও সামর্থ্য ঢেলে দেবার কার্পণ্য থাকে না বলে বিশ্বাস করি।কারণ তার প্রতিটি ম্যাচের খেলার পারদর্শিতার উপর নির্ভর করে একজন খেলোয়াড়ের পেশাগত  পরবর্তী খেলোয়াড়ি জীবন।মুশফিক রহিম সুইপ শর্ট খেলে রান করতে পারেন বলেই এমন শর্ট খেলেন এবং রানও করেন। এখন কোন দিন যদি এমন শর্ট খেলতে গিয়ে তিনি আউট হন তাহলে তার নোংরা সমালোচনায় মেতে ওঠা কতটা যৌক্তিক ?যে শর্টটা খেলে তিনি আউট হয়েছেন সেই শর্টটাতেতো চার রানও হতে পারতো।


আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি,  যারা মাঠে পারফর্মেন্স করবে তাদের খেলার কৌশলের প্রতি পূর্ণ স্বাধীনতা এবং আস্থা রাখা জরুরী একটি টুর্নামেন্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত।কোন খেলোয়াড়ের যোগ্যতার কাটাছেড়া বা বিশ্লেষণ  হওয়া উচিত টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর।বোর্ডকর্তা,সাংবাদিক ও সমর্থদের টুর্নামেন্ট মধ্যবর্তী সমালোচনা হওয়া উচিত গঠনমূলক এবং ইতিবাচক, কখনোই অপমানজনক নয়।   

 চলমান বিশ্বকাপে আমরা দেশের সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া সমর্থকরা সেই সমালোচনাটা গঠনমূলকভাবে করতে পারিনি , বরং সমালোচনার নামে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিজীবন ও খেলার যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করেছে। যা একেবারেই সমীচীন হয়নি।যা আমাদের প্রত্যাশাকে আরও গুড়ে বালি করেছে।এই ব্যর্থতার দায় যেমন খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফদের সেই সাথে বোর্ডকর্তা,সংবাদ মাধ্যম ও সমর্থদের কোন অংশে কম নয় বলে মনে করি।  



মনে রাখতে হবে, যে ইংল্যান্ড ক্রিকেট জন্ম দিয়েছে সেই দল ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছে ২০১৯ সালে, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দল এখনো বিশ্বকাপ ট্রফির স্বাদ পায়নি, তাহলে আমাদের কেন এতো অস্থিরতা?   

বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ১১)

ফ্রান্সে বৃদ্ধ বয়সে অধিকাংশ মানুষ একা থাকেন।এখানে যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে।সন্তানেরা বড় হলে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায়।এমন সামাজিক বাস্তবতায় শেষ বয়সের একা মানুষটির অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা হওয়ার কথা। তিনি অসুস্থ হলে কে তার পাশে থাকবে?কে হসপিটালে নিয়ে যাবে? চিকিৎসা ব্যয় কে বহন করবে? ইত্যাদি। কিন্তু, এ জাতীয় চিন্তা এই ভূখণ্ডের একজন মানুষকে কখনো করতে হয় না। এই সমস্ত চিন্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে আমাদের দেশে একজন সন্তান অসুস্থ হলে তার পিতা মাতা তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য যে ধরণের প্রচেষ্টা চালায়, এখানে রাষ্ট্র তেমন ভাবেই একজন অসুস্থ নাগরিকে সুস্থ করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়।প্রতিটি নাগরিকের বিপদের ডাকে সাড়া দেবার জন্য রাষ্ট্র সর্বদা তৎপর থাকে। চিকিৎসা খাতে নিয়োজিত প্রতিটি কর্মী তার পেশাদারিত্ব শতভাগ প্রয়োগ করে মানুষকে সেবা দেবার প্রচেষ্টা চালায়।এ ক্ষেত্রে প্রতিটি কর্মীর সততা, নিষ্ঠা,মানবিকতা ও আন্তরিকতা যেমন রয়েছে, সেই সাথে রাষ্ট্রের নির্দেশিত আইনের যথাযত প্রয়োগের বিষয়টিও তাদের মাথায় রেখে কাজ করতে হয়।যদি কারো অবহেলায় কোন নাগরিকের অপমৃত্যু হয় এবং তা প্রমাণিত হয়, তাহলে দোষী ব্যক্তি যে পদাধিকারের মানুষই হোক না কেন তাকে শাস্তি পেতে হবে।রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে দেশের প্রতিটি বিভাগ যে কোন সঙ্কটে যোদ্ধার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে সদা প্রস্তুত। তারই প্রমাণ মিলল করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ সহ অন্যান্য খাতের কার্যক্রম দেখে।  


সঙ্কটকালীন সময়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের জনবলের সক্ষমতার চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যায় কয়েকগুণ বেশী ছিল। ফরাসি সরকার নানা ভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় নানা কৌশল অবলম্বন করছে। একদিকে জনগণের জীবন মরণ সঙ্কট অন্যদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট।দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত স্থবির হয়ে পড়েছে। শ্রমিক সঙ্কটে কৃষি ফসল মাঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লক ডাউনের কারণে বন্ধ হওয়া সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন সরকারকে টানতে হচ্ছে, সেই সাথে দেশের চিকিৎসা খাতের ব্যয় বেড়েছে। এখানে জনগণের বিপদ মানে সরকারের বিপদ, আবার সরকারের বিপদ মানে জনগণের বিপদ। তাই জনগণের বিপদে রাষ্ট্র সরব, আবার রাষ্ট্রের বিপদে জনগণ সরব। রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকার অস্থায়ী কিন্তু রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন, নানাবিধ সরকারী প্রতিষ্ঠান,প্রাকৃতিক সম্পদ,অবকাঠামো স্থায়ী এবং তার মালিকানা সবার। তাই কোন কারণে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন সম্ভাবনা দেখা দিলে এ ব্যাপারে সরকারের সাথে সাথে জনগণের উদ্বিগ্নতাও বাড়ে।এর প্রমাণ মেলে দেশের সঙ্কটকালীন সময়ে সরকারের নানাবিধ কাজে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের চিত্র দেখে। যখন ফরাসি সরকার সাধারণ মানুষকে গৃহবন্দি করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে, যখন মানুষ জীবন হারানোর ভয়ে শঙ্কিত, তখন দেশের স্বাস্থ্য খাতে নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স, এম্বুলেন্স সার্ভিসে কর্মরত কর্মীগণ ভয়কে জয় করে বিরামহীন ভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে সেবা প্রদান করে চলেছে। যারা এই খাতে চুক্তিবদ্ধ চাকুরী করেন তাদের হয়তো কর্মের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।কিন্তু যাদের বাধ্যবাধকতা নেই ,নিজেকে রক্ষা করাই যাদের মুখ্য দায়িত্ব, সেই সব মানুষের সাহসিকতা সত্যি ভাবিয়ে তোলে ।  


মানুষ কত মহান হতে পারে, তা দেখার সুযোগ মেলে মানুষের দুর্যোগকালীন সময়ে।বয়স যাদের পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্ব,এই দুর্যোগকালীন সময়ে জীবন যাদের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।যদি আক্রান্ত হয় করোনা ভাইরাসে, তবে জীবন ফিরে পাওয়া অনেকটাই লটারির মত। তাতে কি, জীবনতো স্থায়ী নয়,একদিন অসীম শূন্যের দিকে ধাবিত হতেই হবে অনিবার্য।যাত্রা পূর্বে যদি রেখে যাওয়া যায় কোন মহত্ত্বের নিদর্শন তবেই না সার্থক জীবন।বলছি ,কর্মজীবন থেকে অবসরে চলে যাওয়া ফরাসি ডাক্তার নার্সদের মহত্ত্ব গাথার কথা । যে সময় ঘরে বসে পেনশনের টাকায় আরাম আয়েশ করার কথা,সর্বোচ্চ সতর্কতায় ঘরের খিল মেরে নিজেকে সাবধানে রাখার কথা অথচ মানুষের ঘোর বিপদের দিনে এইসব ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলো ঘরে বসে থাকেনি,মানবিক বোধের তাড়নায় অবসর ভেঙে আবার শুভ্র পোষাকে এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে ফিরে আসে হসপিটালে,দাঁড়ায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মুমূর্ষু মানুষের বিছানার পাশে।নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অন্যের জীবনের আলো ফোটানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেবা দিতে  শুরু করে  বিরামহীন ভাবে। এদের মধ্যে ছিলোনা কোন খ্রীষ্টীয়ান, মুসলিম,ইহুদী, হিন্দু,বুড্ডিস্ট,নাস্তিক অথবা সাদা বা কালো রঙের বিশেষ গোত্র প্রীতি।একটাই তাড়া মানুষকে বাঁচাতে হবে।চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ডাক্তার নার্সের ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়েছে, সে সংবাদ জেনেও তারা ভীত না হয়ে অবসর ভেঙ্গে স্ব পেশায় প্রত্যাবর্তন করেন।পরবর্তীতে এদের মধ্যে থেকে মৃত্যু মুখে পড়তে হয় কয়েকেজন ডাক্তার ও নার্সের।ঐ সময় ফরাসি সরকার তাদের মহত্ত্বকে বীরের মর্যাদায়  স্মরণ করেন।   

অবসর নেয়া ফ্রান্সের সবচেয়ে বয়স্ক ডাক্তার ক্রিস্তিয়ান সেনে Dr. Christian Chesnay।বয়স একশ ছুঁই ছুঁই।তিনি জানেন, করোনা ভাইরাস তার জন্য সবচেয়ে বেশী ভয়ংকর। তবুও তিনি ফ্রান্সের ভাল দো মারণ Val-de-Marne অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য অবসর ভেঙ্গে পুনরায় স্বপেশায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ঘোষণা দেন এই মহামারি চলে গেলে তিনি পুনরায় অবসরে চলে যাবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ব্যাপারটি জেনে আশ্চর্য হন। তার সম্মানার্থে পহেলা মে শ্রম দিবসে তাকে এলিজে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান এবং ফরাসি জনগণের পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।    

ফ্রান্সের ক্ষমতাসীন দলের সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ( Agnès Buzyn)  আনিয়েস বুজা। তিনিও রাজনীতি ফেলে( Hospital D'instruction Des Armées Percy)  হসপিটাল পেরসিতে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য যোগদান করেন এবং ঘোষণা দেন সামনের মহামারীর দিনগুলিতে আমার প্রথম পরিচয় হবে আমি একজন ডাক্তার।   


এমন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের যথাযত বিশেষ কোন শব্দ অভিধানে আছে কি ? আমার জানা নেই। 


যাদের ঘরে বসে কম্পিউটার গেমসে ব্যস্ত সময় পার করার কথা, অথবা কোন বন্ধুর টেলিফোনে আবেগ মিশ্রিত কথায় বুঁদ হয়ে কল্পনার ভেলায় ভেসে বেড়ানোর কথা ,জীবনের এই সোনালী সময়ে বাকী জীবন উপভোগের কথা ভেবে বিপদসংকুল পথ এড়িয়ে চলার কথা, তাদেরই মধ্য থেকে সময়ের সাহসী তরুণ তরুণীদের অনেকেই সকল ভয়কে তুচ্ছ করে করোনা মহামারী রুখতে ফরাসি মেডিকেল টিমের সহযোগী হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কর্মব্যস্ত সময় পার করেছে।ভেবে প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে বুক, এদের হাতেই আগামীর দেশ, রচিত হবে আগামীর মানবিক ও প্রাণবিক পৃথিবী ……


এপ্রিল মাস,ফ্রান্সে স্ট্রবেরি ফলের পাকার মৌসুম। পাকা ফলগুলো শ্রমিক সঙ্কটের কারণে মাঠেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকদের সহায়তার জন্য জনগণের কাছে স্বেচ্ছা শ্রমের আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইডে জমা পড়ে লক্ষাধিক মানুষের স্বেচ্ছা শ্রম দেবার আবেদন। 

এমন দৃষ্টান্তগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে একটি মানবিক রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিণত হয়ে ওঠে একটি পরিবার রাষ্ট্রে।সুতরাং, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একে ওপরের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও প্রচেষ্টায় যেমন ভালো রাখা সম্ভব একটি যৌথ পরিবার, তেমনি রাষ্ট্র নামক বৃহত্তর পরিবারকেও। 

 

করোনাকালে কিছু কিছু মানুষের মহানুভবতার কথা সত্যি আগামীর জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। 


আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তাওসিচ লিও ভারাডকার ছিলেন পেশায় একজন চিকিৎসক। সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে টানা সাত বছর মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।২০১৩ সালে মেডিক্যাল রেজিস্টার থেকে তার নাম কাটা পড়ে। কিন্তু, দেশের সামগ্রিক দুর্যোগের কথা ভেবে আবারো তার নিবন্ধন করেন। ঘোষণা দেন, তিনিও ডাক্তারদের পাশে থেকে সরাসরি করোনা আক্রান্ত মানুষদের সপ্তাহে একদিন চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন।  


স্পোর্টিং লিসবনের প্রেসিডেন্ট ফ্রেদেরিকো ভারান্দাস দেশের প্রয়োজনে আবারো গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে চিকিৎসা পেশায় ফেরেন। 

এদের মত অন্য পেশায় নিয়োজিত ও বড় আসনে অধিষ্ঠিত চিকিৎসা জ্ঞান অর্জনকারী অনেক মহান মানুষ নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে সাদা পোশাকে মুমূর্ষু মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। যাদের নাম হয়তো কোন মিডিয়ায় প্রকাশ হয়নি। তা তারা চায়ও নি। শুধুই মানবিকতার টানে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। 


আমরা অনেকেই নিজেকে মহান ভেবে শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করি। মনে হয়েছে, ওদের মহত্ত্বের বিশালতার কাছে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে পরিমাপ করে নেবার সময় হয়তো এবার এসেছে। আমার 

নিজেকেই মনেই হয় ওদের মহত্ত্বের উচ্চতার কাছে কি ক্ষুদ্র ,নগণ্য মানুষ আমি !

 করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ১০)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৯)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৮)  

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

শনিবার, ১ মে, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ১০)

একবার আমাকে এখানকার একটি হসপিটালের অপারেশন টেবিলে যেতে হয়েছিলো।অপারেশন টেবিলে যাবার পূর্ব থেকে হসপিটাল ছাড়ার পর পর্যন্ত দারুণ এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম।যা আমাকে এই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের গভীরতা আরও বাড়িয়েছে।   

দীর্ঘদিন একটি শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলাম। জেনারেল ডাক্তার দেখিয়ে ঔষদ সেবন করে শুশ্রূষা পাচ্ছিলাম না। দিন দিন সমস্যা বাড়তে লাগলো। জেনারেল ডাক্তার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট পাঠালো। তিনি ঔষদ দিলেন, কিন্তু তাতে সমস্যা থেকে মুক্তি পেলাম না। বেশ কয়েকবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট যাওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশন করতে হবে। ইতোপূর্বে শরীরে কোন ছুরী কাঁচি চলেনি তাই একটু ভয় হলো। ডাক্তার বলল, খুবই সাধারণ অপারেশন, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি মানসিক ভাবে তৈরি হলাম। অপারেশনের তারিখ নির্ধারণ হল ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। চাকুরীর স্থান থেকে পনেরো দিনের ছুটি নিলাম।ডাক্তারের নির্দেশ মত সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অপারেশনের দিন সকাল বেলা আমি ও জান্নাত হসপিটাল মারি থেরাচ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।এখানে নিয়ম অপারেশনের দিন অবশ্যই সঙ্গে একজন মানুষ থাকতে হবে। যে অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার পরে রোগীকে গ্রহণ করবে এবং সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। এজন্যই জান্নাত আমার সঙ্গে এসেছে। মিশেলকে বাসায় ঘুমের মধ্যে রেখে আসা হয়েছে। আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলে জান্নাত বাসায় ফিরে আসবে। অপারেশন শেষ হলে, পরে আবার হসপিটালে আসবে আমাকে নিতে।

হসপিটালের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে সকাল নয়টার দিকে হসপিটালের অপারেশন সেকশনে প্রবেশ করলাম।সেবিকাদের নির্দেশ মত অনেক কিছু করতে হল। কেউ অপারেশনের পোশাক পরতে সাহায্য করলেন, কেউ ঔষদ খাইয়ে দিলেন, কেউ সঙ্গে করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন।এদের আন্তরিক ব্যবহারে সবাইকে খুব আপন মনে হচ্ছিল। 


অপারেশন থিয়েটারের ঢুকে দেখি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন ডাক্তার নার্সদের সমন্বয়ে ছয় সাতজনের একটি টিম। মনে করেছিলাম সাধারণ অপারেশন, কিন্তু এত সাজসজ্জা ও প্রস্তুতি দেখে মনে হল বড় কিছু হতে যাচ্ছে। আমাকে একজন সেবিকা অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দিলেন।শরীরে কয়েকটি ইনজেকশন পুস করা হলো। একজন ডাক্তার গল্পের ছলে আমার ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে করতে মুখে মাস্ক পরিয়ে দিলো। আমার চোখ দুটি ধীরে ধীরে বুজে আসতে লাগলো।মনে হলো দেহ মন জুড়ে অবসন্ন ধেয়ে আসছে। কেমন যেন এক প্রশান্তির ঘুম আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য এক সুখ স্বর্গে। আমি গভীর ঘুমে চলে গেলাম…… 

আমার মনে হচ্ছে পাহাড়ি কোন গহীন অরণ্যের ছায়া শীতল ঝর্না ধারার পাশে শুয়ে আছি। অসম্ভব এক আনন্দধারা বয়ে যাচ্ছে হৃদয়জুড়ে।এক সুখ স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছি।হঠাৎ আমার মনে হল আমিতো অপারেশন টেবিলে ,আমার অপারেশন কি সম্পন্ন হয়েছে? আমি আস্তে আস্তে বলার চেষ্টা করছি, আমার অপারেশন কি হয়েছে? চোখে গভীর তন্দ্রা, চোখ খুলতে পারছিনা। আমার পাশ থেকে এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, সে বলছে আপনার অপারেশন হয়ে গেছে। আপনি এখন ঘুম থেকে জেগে ওঠা রুমে আছেন। অপারেশনের পর রুগীদের জ্ঞান ফেরার জন্য রাখা হয় এই রুমে। ফরাসি ভাষায় এই রুমকে বলে salle de réveille ছাল দো রেভেই।ধীরে ধীরে আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি । ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পাশে এক তরুণী বসে আছে। অনেক বড় রুম, আমার মত আরও অনেকেই বিছানায় শুয়ে আছে। কেউ ঘুমে, কেউ জেগে। এদের প্রত্যেকেরই অপারেশন করা হয়েছে। ডাক্তার নার্সরা অপেক্ষা করছে এদের জ্ঞান ফেরার জন্য।আমার হাতে স্যালাইনের সুচ লাগানো রয়েছে।এর মাঝে আমার উপর ডাক্তারের ছুরিকাঁচি চলেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। তবে শরীরের কাটা-ছেঁড়া অংশে ব্যান্ডেজ দেখে বুঝলাম সত্যি মূল কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।জীবনের প্রথম এনাস্থেসি নেবার পর বুঝলাম, আমরা যে বেছে আছি তা আমাদের সক্রিয় মস্তিষ্ক মাধ্যমে অনুভূত হই। মস্তিষ্ক যখন সুপ্ত অবস্থায় চলে যায় তখন ইন্দ্রিয় অনুভূতিগুলো আমাদের নিকট ধরা দেয় না। যেমন, আমার শরীরে যে সময়টাতে ছুরিকাঁচি চলেছে ওই সময়ের বিন্দু পরিমাণ স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক ধরে রাখতে পারেনি। কারণ আমার মস্তিষ্ককে এতটাই অচেতন করা হয়েছিল যে আমি আমার শরীরের মধ্যে ছিলাম না। শরীর ও আমার অস্তিত্ব আলাদা হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে আমার শরীরে উপর দিয়ে কি চলেছে তা আমার অনুভূতিতে ধরা পড়েনি। মানুষের মৃত্যুটা হয়তো এমনি, দেহ থেকে যখন আত্মা বা অস্তিত্ব বিদায় নেয় তখন এই শরীরকে পোড়ালেও মানুষ কিছু টের পায় না।আত্মা বা অস্তিত্বের অনুপস্থিতে দেহ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাই রক্ত মাংসের মূল্যহীন দেহকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথিবীর বুক থেকে ধ্বংস করার জন্য আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অনেক সময় শোনা যায়, এনেস্থেসি দেবার পর অনেকের জ্ঞান ফিরে না আসায় মৃত্যু ঘটে ।    


যখন পরিপূর্ণ ভাবে আমি জেগে উঠলাম তখন আমাকে এই রুম থেকে নিয়ে যাওয়া হল অন্য একটি রুমে। বসতে দেয়া হল একটি চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর একজন সেবিকা চা কফি আর বিস্কুট ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে আসল । আমি চা আর বিস্কুট নিলাম। চা পান করার পর প্রসাবের বেগ অনুভূত হল। একজন সেবিকার সহায়তায় টয়লেটে গেলাম। কিন্তু খুব চেষ্টা করে প্রসাব করতে পারলাম না। ফিরে এসে সেবিকাকে বললাম,  প্রসাব বের হচ্ছেনা। নার্স বললেন,অপারেশনের জন্য আপনাকে প্রসাব বন্ধ রাখার ঔষদ খাওয়ানো হয়েছিল, এজন্যই সমস্যা হচ্ছে তবে চিন্তার কারণ নেই, খুব দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার স্ত্রী আসলো আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে। আমার প্রচণ্ড বমি বমি ভাব অনুভূত হচ্ছে।আমার স্ত্রী জান্নাত কর্তব্যরত নার্সদের বিষয়টি জানালে তারা কয়েকটি কাগজের বমি করার পট দিয়ে গেলো, আর বলল আমরা ডাক্তারকে জানাচ্ছি। বেশ কয়েকবার বমি করলাম।ডাক্তার এলো দেখতে, জিজ্ঞেস করলো কেমন অনুভব হচ্ছে? বাসায় যেতে পারব কিনা? কিন্তু বমি বাড়তে থাকায় এবং শারীরিক অবস্থা দেখে ডাক্তাররা একদিন হসপিটালে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো।  

আমার জন্য একটি ক্যাবিন বরাদ্দ দেয়া হল। ডাক্তার কিছু নির্দেশাবলী মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে চলে গেলো। শারীরিক অস্বস্তি ক্রমেই  বাড়ছে। কিছুক্ষণ পর পর বমি হতে লাগলো। একজন সেবিকা ও আমার স্ত্রী জান্নাত আমাকে ধরে ক্যাবিনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। স্বয়ংক্রিয় বিছানা,অনেকগুলো সুইচ বাটন রয়েছে,বিছানায় শুয়ে শুয়েই প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। টিভি দেখা, বিছানা প্রয়োজনে ভাজ করা ও সোজা করা করা,এছাড়া খাওয়ার জন্য ছোট্ট টেবিল প্রস্তুত করা ইত্যাদি বিছানায় শুয়ে শুয়েই করা যায়।সব সিস্টেম বিছানার সঙ্গে সংযুক্ত। সেবিকা বিছানার সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিটি বাটনের কাজ বুঝিয়ে দিলেন। একটি বাটনের কথা বিশেষ ভাবে বললেন। বললেন, যদি কখনো খুব খারাপ লাগে যেকোনো সময় এই বাটনে চাপ দেবেন আমরা চলে আসবো, কোন চিন্তা করবেন না, সার্বক্ষণিক আমরা আপনার পাশে আছি। 


মেয়েকে বাসায় রেখে আমার স্ত্রী হসপিটালে এসেছে। তার মধ্যে মেয়ের জন্যও অস্থিরতা কাজ করছে। ছোট মানুষ যদি না বুঝে কোন দুর্ঘটনা ঘটায়। ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতো, কিন্তু হসপিটালের অপারেশন ইউনিটে শিশুদের প্রবেশ নিষেধ।প্রায় সন্ধ্যে নেমে এসেছে,কেবিনের জানালা দিয়ে দেখছি হসপিটালের করিডোরের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। জান্নাত আমাকে রেখে চলে গেলো। হসপিটালের ক্যাবিনে আত্মীয় পরিজনহীন একা হলে নিজেকে একা মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর সেবিকারা নিয়ম করে ঔষদ খাইয়ে দিচ্ছেন, ট্রেতে খাবার সাজিয়ে আনছেন,শরীরের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করছেন। ক্যাবিনের রুমটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রুমের মধ্যেই টয়লেট,বাথরুম। সবকিছু চকচকে, তকতকে ।ঔষদ সেবনের পর বমি বমি ভাবটা চলে গিয়েছে। শরীরটাও একটু ফুরফুরে অনুভব হচ্ছে। কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম।নির্জন রুমে একা, জীবন জগত নিয়ে অনেক কিছু ভাবনায় ভর করলো 


জীবনে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার জন্য অর্থকড়ি ধন সম্পদের প্রয়োজন অপরিহার্য।আমরা ভাবি, ধন সম্পদের মওজুদ যত বাড়বে জীবন অধিক নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে।তাই, জীবনকে নিরাপদ রাখার  জন্য আমরা হন্য হয়ে ব্যক্তিগত ধন সম্পদ অর্জনের জন্য ছুটে চলি।সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সম্পদ বলতে জড় পদার্থের পার্থিব সম্পদকে বুঝি। এই পার্থিব সম্পদের মধ্যে  সুখ ও নিরাপত্তা খুঁজতে খুঁজতে অনেক সময়  জীবনের প্রকৃত সম্পদ অযত্নে অবহেলায় অসময়ে বিনষ্ট সাধন করি।অনেকে আমরা সারা জীবনে একবারও উপলব্ধি করতে পারি না,কি মূল্যবান সম্পদ সঙ্গে নিয়ে আমরা পৃথিবীতে আসি! 


সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ সেই যিনি সুস্থ শরীরে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সুস্থ ভাবে বেঁচে আছেন।মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও সুস্থ শরীর।এই সম্পদ যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্তই তাকে ঘিরে এই ধরিত্রীর যা কিছু রয়েছে সব তার অনুভূতিতে সুন্দর এবং অসুন্দর  অনুভূত হয়।রাষ্ট্রীয় আইন কানুন দ্বারা সুরক্ষিত সম্পদের পাহাড় মূল্যহীন হয়ে যায় তখনি যখন প্রকৃতিগত ভাবে প্রাপ্ত শরীর কার্যকারিতা হারায়।

 বাহির এবং অভ্যন্তরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা গঠিত আমাদের মানব দেহ।প্রতিটি অঙ্গ আমাদের পূর্ণাঙ্গ দেহকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি ক্ষণ কাজ করে যায়।প্রতিটি অঙ্গ যখন একযোগে স্বয়ংক্রিয় ভাবে কার্যকারিতা অব্যাহত রাখে তখনি জীবনের পূর্ণাঙ্গ স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। 

যখন আমরা পূর্ণ সুস্থতা নিয়ে জীবন যাপন করি, তখন উপলব্ধি করতে পারি না এক একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গুরুত্ব কতটুকও। 


আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, « মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি » ।কথাটি আমাদের সমাজের  অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার ও অনিয়মতান্ত্রিক  রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্বাস করা হয়। আমাদের সমাজে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে মানুষের প্রত্যাশা ও কর্মের সাথে প্রাপ্তির সম্পর্ক নেই বলে, মানুষ ভাগ্য এবং অদৃশ্য শক্তির উপর অধিক ভরসা করে জীবন যাপন করে।এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে, আমাদের সমাজে কেউ সারা জীবন সৎ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জীবন যাপন করে তিন বেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খায়। আবার অনেকে বাঁকা পথে এক বছর হেঁটে চৌদ্দ পুরুষের ভরণ পোষণের সম্পদ উপার্জন করতে পারে। এই অনিয়ম মানুষকে ভাগ্য বিশ্বাসের দিকে দ্বিগুণ ভাবে প্রভাবিত করে। 

অর্থাৎ মুখ যিনি দিয়েছেন তিনি সারা জীবন মুখের আহারের ব্যবস্থা করবেন তার গায়েবী রহমতে,এই আহার জোটানো নিয়ে আমাদের এতো ভাবনার দরকার নেই, কোন কর্ম পরিকল্পনার প্রয়োজন নেই।এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের ছোট্ট সীমারেখার দেশটিতে শুধু মানুষের মুখ আর মুখ। সেই মুখ গুলোর মধ্যে কোন মুখ মিষ্টিমণ্ডা, কোরমা পোলাওয়ের সাধ আস্বাদন করে, কোন মুখে কোন মত ডাল ভাত জোটে, কোন মুখে ঠিক মত আহারই জোটে না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে প্রবাদটির সত্যতা এবং বাস্তবতা খুঁজে পাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। মুখ যিনি দেন  তিনি মূলত মুখের সারা জীবনের আহার সঙ্গে করেই একজন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠান।কথাটি শুনে একটু হোঁচট লাগতে পারে, কিন্তু একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে উত্তর মিলে যাবে।আমাদের বিশ্বাসের জায়গা থেকেই বলি, আল্লাহ বা ঈশ্বর একজন মানুষকে শুধু মুখ আর পেট দিয়েই এই পৃথিবীতে পাঠান না। চিন্তা করার জন্য প্রাণী জগতের সবচাইতে উৎকৃষ্ট মস্তিষ্ক ,দেখার জন্য চোখ , ধরার জন্য হাত , হাঁটার জন্য পা , শোনার জন্য কান , শ্বাস প্রশ্বাসের গ্রহণের জন্য নাক দেহের সঙ্গে যুক্ত করেই পৃথিবীতে পাঠান।দেহের এই যে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার দেয়া মুখের সারা জীবনের আহার।আমার ব্যক্তিগত ভাবনা, স্রষ্টার এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেবার উদ্দেশ্যই হল একজন মানুষ তার দেহের এই সম্পদের( অঙ্গ প্রত্যঙ্গ) সঠিক ব্যবহার করে নিজের মুখের আহার জোগাড় করবে সমাজের ভেতর থেকে।দেহের এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার না করে বা স্রষ্টা প্রদত্ত শক্তি কাজে না লাগিয়ে অদৃশ্য শক্তির দিকে মুখের আহারের জন্য চেয়ে থাকা হচ্ছে জ্ঞানহীন মানুষের অজ্ঞতা।একটি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে একজন মানুষ যদি তার শরীর নামক শ্রেষ্ঠ সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করতে পারে তাহলে শুধু নিজের মুখের আহারই নয়, শত মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে সক্ষম।

আমাদের শরীরটাই যে মুখের আহার উপার্জনের মাধ্যম সেটা বাস্তবতা দিয়ে বোঝা সম্ভব একজন অঙ্গহানী মানুষের জীবনের প্রতিকূল দিকগুলোর দিকে তাকালে।অন্যদিকে আমাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সৃষ্টিকর্তার দেয়া কত বড় সম্পদ সেটা বোঝা সম্ভব দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে।কোন রোগভোগে বা দুর্ঘটনায় যদি চোখের আলো চলে যায়, তাহলে এই সুন্দর পৃথিবীটাই আমার কাছ থেকে কত দূরে সরে গেলো।এমন পরিস্থিতিতে চাইব আমার সমস্ত পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে হলেও চোখের আলো ফিরিয়ে এনে এই সুন্দর ধরণীর বুকে বেঁচে থাকতে।

যে চোখ এখনো আমাকে পৃথিবীর আলো উপভোগ করাচ্ছে, সেই চোখের মূল্য কি অর্থের বিনিময়ে পরিমাপ যোগ্য, যে অমূল্য সম্পদ আমি ধারণ করে আছি।চোখের মত আমাদের হাত,পা,নখ,কান,জিহ্বা, পেট,যৌনাঙ্গ,মলদ্বার,কিডনি,হৃদপিণ্ড,যকৃতের মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসহ দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে প্রতিনিয়ত যে সুবিধা গ্রহণ করে থাকি তার গুরুত্ব আলাদা করে ভাবার অবকাশ আমাদের খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে।কোন অঙ্গ যখন রোগাক্রান্ত হয়ে বিকল হয়ে পড়ে,অথবা একটি অঙ্গের আক্রান্ত হওয়ার কষ্ট যখন সমস্ত দেহ ও মনকে আচ্ছাদিত করে তখনি আমরা অনুধাবন করি দেহের প্রতিটি ক্ষুদ্র অঙ্গের অবদান ও গুরুত্ব কতটা গভীর  


একদিন নিজস্ব জীবন বোধ নিয়ে কথা হচ্ছিলো একজন তত্ত্ব জ্ঞানীর সঙ্গে। আমি নিজেকে এই পৃথিবীর একজন পর্যটক ভাবি,কারণ যেখান থেকে পৃথিবীতে আসা কিছু বছর বা সময়ের জন্য, আবার সেখানেই প্রত্যাবর্তন করা বাধ্যতামূলক। তাই, এই সীমিত সময়ের মধ্যে পৃথিবীর মানুষের তৈরি জটিলতা থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে মুক্ত রেখে জীবন ও জগতের মধ্যে বিদ্যমান অবারিত  সৌন্দর্যের স্বাদ প্রাণ ভরে গ্রহণ করা ও মানব সৃষ্ট জটিলতার সমাধানের জন্য কাজ করার মধ্যেই  আমার  প্রাপ্ত মানব জনমের সার্থকতা ও সমৃদ্ধি খুঁজি ।ওনার জীবন বোধ ব্যাখ্যা করলেন একটু অন্যভাবে।তিনি নিজেকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারক মনে করেন।কারণ প্রতিদিন সূর্য ওঠে আবার অস্ত যায়, রাতে চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়ায়, ফুল ফোটে, বাতাস বয় এগুলো এই  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিত্য কর্মকাণ্ড।ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে অস্তিত্বের অনুভূতির সংযোগ অপরিহার্য, সেই অস্তিত্বই হচ্ছি আমি।আমার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে বলেই ওদের কার্যক্রম সার্থক,আমি ওদেরকে ধারণ করি এবং ওদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই বলেই ওরা এতো সুন্দর।আমার অস্তিত্ব যদি এই পৃথিবীতে না থাকে তাহলে সূর্য উঠলেই আমার কি, আর চন্দ্র জ্যোৎস্না না ছড়ালেইবা আমার কি যায় আসে। অর্থাৎ, এই পৃথিবী ও ব্রহ্মাণ্ডের প্রাত্যহিক কার্যক্রম চলমান এবং এই যাত্রা অসীমের দিকে।আমরা প্রত্যেকেই এই অসীমের মাঝে ক্ষণকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এক একটি অংশ।ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত আমার অস্তিত্ব বিরাজমান এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে, ততোক্ষণ পর্যন্তই এই পৃথিবীতে বিরাজমান সবকিছু আমার।প্রকৃত জগত একটা হলেও প্রতিটি মানুষের জগত আলাদা আলাদা।একটি শিশুর নিজস্ব জগত তার নিজের মত,সে জগতকে সেই ভাবে চিন্তা করে, যেভাবে সে আবিষ্কার করে। ওই শিশুর মতই একজন কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, অসুস্থ, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী বিভক্ত মানুষের এক একটি জগত তাদের নিজস্ব ভাবনায় যেমন।  

ফুল সর্বদায় সৌন্দর্য বিলায়, ঊষার আলো সর্বদাই হলুদ,মৃদু বাতাস সর্বদাই প্রশান্তির, কিন্তু তা আপনার জগতে সুন্দর হয়ে ধরা দেবে তখনি যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার আত্মার বসবাস হবে আপনার সুস্থ শরীরের মধ্যে।মগজের মধ্যে যদি সারাক্ষণ কূট কূট ব্যথা অনুভূত হয় তাহলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের আলো রাতের নিকষ  কালো অন্ধকারের মতই। অন্যদিকে ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড়ের মানসিক প্রশান্তি নিমিষেই অশান্তিতে নিপতিত হয়, যখন ডাক্তার বলে দেয় আপনার ক্যান্সার আক্রান্ত দেহের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে মাত্র আর কয়েকটি মাস। 


একজন মানুষের অস্তিত্ব, আত্মা ও দেহের সমষ্টি। আত্মা এবং দেহ  দুইটি আলাদা সত্ত্বা। 

ভারতীয় দর্শনে আত্মা ও দেহ সম্পর্কে একটি মত প্রচলিত রয়েছে,আত্মা অজড়ীয়,অবিভাজ্য এবং অবিনশ্বর।দেহ নশ্বর এবং পোশাকের মত। জীর্ণ পোশাক ত্যাগ করে নতুন পোশাক পড়ার মত আত্মা ভগ্ন জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহের সন্ধান করে।অর্থাৎ আত্মা ভগ্ন জীর্ণ রোগাক্রান্ত দেহে অবস্থান করতে চায়না।এই মত অনুসারে আপনার শরীর যদি সুস্থ ও সতেজ না হয় তাহলে আপনার শরীরের মধ্যে বসবাসরত আত্মাও আপনার দেহ ছেড়ে পালাতে চায়।তাই নিজের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের যত্ন নেয়া অপরিহার্য এবং পৃথিবীর জীবনের স্বাদ দীর্ঘায়িত করতে শরীরকে গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য। 


শরীর থাকলে সেই শরীরে রোগ বাসা বাধবে এটাই নিয়ম। তবে সেই রোগ সৃষ্টির জন্য নিজের ভুল এবং রোগ মুক্তির  প্রচেষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরী। 

ইসলাম ধর্মে হালাল হারামের ভেতর দিয়ে মানুষের গ্রহণ বর্জনের বিভাজন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে মূলত ভালো ও সুস্থ থাকাকে উদ্দেশ্য করে।ইসলাম ধর্মে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নেয়ার চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।নেশা জাতীয় দ্রব্য ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে,কিন্তু সেই উপদেশ অমান্য করে যদি নেশা জাতীয় দ্রব গ্রহণের দ্বারা অসুস্থ হই, তাহলে সেই অসুস্থতার ফল নিজেকেই ভোগ করতে হবে। শুধু তাই নয় কেয়ামতের দিন আল্লাহর দেয়া শরীর ইচ্ছাকৃত ভাবে নষ্ট করার জন্য  কৈফিয়তের সম্মুখীন হওয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।  

হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন বান্দাকে নিয়ামত সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা সম্পর্কে। তাকে বলা হবে, আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৩৫৮)। 


আমার মনে হচ্ছিলো, পার্থিব সম্পদের দিকে আমরা অবশ্যই ছুটবো, তবে সেই ছোটার উদ্দেশ্য হবে জীবনের মূল্যবান সম্পদ শরীর নামক দেহটাকে রক্ষার জন্য অর্থাৎ সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য। শরীরকে বঞ্চিত করে অথবা ধ্বংস করে  পার্থিব সম্পদ জমানোর নেশা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।যে সম্পদ জীবনকে সুন্দর অনুভূতিতে ভরে দিতে পারে, সেই সম্পদ রক্ষার প্রচেষ্টাই হবে জ্ঞানের পরিচয়। 


নিজের শরীর নিয়ে এতো গভীর চিন্তা বা উপলব্ধি আমার কখনো হয়নি। মনে হল জীবনে বেঁচে থাকতে হলে কত বিচিত্র পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এক একটি পরিস্থিতি মানুষকে জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবায়, নতুন করে শেখায়, জীবনের গতি পথ পরিবর্তন করে দেয়। এটাই মনে হয়, জীবনের বৈশিষ্ট্য। 


টিভি দেখা আর জীবন জগত ও সমাজ নিয়ে ভাবতে ভাবতে মধ্যরাত হয়ে এলো।কলিং বেল বাজিয়ে একজন নার্স এলো দিনের শেষ ঔষদটি খাওয়াতে। ব্যথার ঔষদ,কারণ রাতের কয়েক ঘণ্টা পাড়ি দিতে হবে।  ঔষদ না খেলে কাটাছেড়া অংশে ব্যথা বাড়বে।ডাক্তার নার্সদের ক্ষণে ক্ষণে তদারকি,হসপিটালের পরিবেশ, আমার সুসজ্জিত কেবিন,  সবমিলিয়ে আমার কখনোই মনে হয়নি আমি অসুস্থ রোগী হয়ে হাসপাতালে আছি। মনে হয়েছে, কোন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অবকাশ কালীন সময় কাটাচ্ছি।  


দারুণ একটি ঘুমের রাত পাড়ি দিয়ে দিলাম।  জানালার কাঁচ ভেদ করে সকালের সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। নতুন দিনের আলোয় ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি জান্নাত টুথপেস্ট, টুথ ব্রাশ, কিছু ফল নিয়ে আমার কেবিনে হাজির।অসুস্থতার সময় প্রিয় মুখগুলো আরও প্রিয় হয়ে ওঠে, যদি অসুস্থ বিছানার পাশে তাদের দেখা যায়।আমি জীবনে অনেকবার খুব জ্বরে ভুগেছি। প্রতিবার তেরো চৌদ্দ দিনের ভোগান্তি।এক সময় ঘুমহীন রাত জেগে বাবা মা সেবা সুশ্রুসা দিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুলতেন। বিয়ের পর আমার স্ত্রী জান্নাত প্রতিবার আমার অসুস্থতার সময় খুব যত্নের সহিত আমার পাশে থেকে সেবা করেছে। কখনো বিন্দু পরিমাণ অবহেলা করেনি। যখন আমরা দুজন ঢাকা থাকতাম তখন একবার প্রচণ্ড জ্বরে পড়লাম,বাসায় আমাকে দেখার কেউ নাই, জান্নাত প্রায় বারো তেরো দিন অফিসে যাওয়া বন্ধ করে সার্বক্ষণিক আমার পাশে থেকেছে। ঝগড়াঝাঁটি, মান অভিমান ভুলে গিয়ে আরও গহীন আপন মানুষ হয়ে এই অসুস্থকালীন সময়ে সেবা করেছে।ওর ক্ষেত্রে হলে আমি ওর মত করে ওকে সেবা করতাম কিনা, আমার নিজেরই সন্দেহ রয়েছে।এ ক্ষেত্রে ও আমার থেকে অনেক মহৎ মানুষ। আজ হসপিটালে আমার বিছানার পাশে ওর উপস্থিতিতে সেই আগের মতই মমত্ব ভাব ফুটে উঠলো। আমার অপারেশনের কথা অবশ্য কাউকে বলিনি, সবাই এখানে কারণে অকারণে ব্যস্ত থাকে।জেনে কষ্ট ও সময় ব্যয় করে কেউ ছুটে আসবে তাই কাউকে না জানিয়েই হসপিটালে ভর্তি হয়েছি।তাছাড়া অপারেশনটাও খুব বড় মাপের ছিলোনা। 


ডাক্তার এসে সার্বিক শারীরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমাকে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন।বাসায় কিভাবে শরীরের কাটাছেঁড়া অংশের যত্ন নিতে হবে, ঔষদ সেবন করতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন।হাসপাতালের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমরা বাসায় চলে এলাম। ফ্রান্সের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আমার নতুন এক ধারনার জন্ম নিলো।বিপদকালিন দুইদিনের হসপিটাল জীবন থেকে বিশেষ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম ।আমি হসপিটালে ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে সময় কাটালেও আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি ছিলাম পারিবারিক পরিবেশে এবং আমার পাশে থেকে সেবা করেছে আমার বাবা মা অথবা আপন ভাই বোন। 

 

ফ্রান্সে আমার ব্যক্তি জীবনে উল্লেখিত দুটি স্বাস্থ্য সমস্যায় যে ভাবে স্বাস্থ্য সেবা পেয়েছি, করোনা সঙ্কটকালীন সময়েও আক্রান্ত মানুষ একই রকম যত্নে স্বাস্থ্য সেবা পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৯)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৮)  

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৯)

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াই কৌশলের বর্ণনা পূর্বে এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা একটু বর্ণনা করে নিলে অনুধাবন করতে অনেকটা সহজ হবে। 

অনেক ছোটোখাটো শারীরিক সমস্যায় অনেকবার এখানকার ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছি।আমি জীবনের অধিকাংশ সময় জন্মভূমি বাংলাদেশে অতিবাহিত করে এসেছি,ফলে আমার কাছে নিজের জন্মভূমির রীতিনীতি ও সমাজ সংস্কৃতির সাথে ফ্রান্সের পার্থক্যটা খুব সহজেই ধরা পরে।পার্থক্যগুলো ফরাসি জীবন ধারায় স্বাভাবিক হলেও আমার কাছে বিশেষ। 

 প্রথমত আমি লক্ষ্য করেছি ,এখানকার ডাক্তাররা মনে করে না,তিনি একটি বিশেষ পেশার মানুষ।তাদের আচরণে প্রকাশ পায়, তার পেশাটা সমাজের অন্যান্য পেশার মতই একটি সাধারণ পেশা।তাই অন্য যে কোন পেশার  মানুষদের সাথে  যখন মিলিত হয় তখন পেশাগত অহংকার বা দম্ভ ফুটে ওঠেনা তাদের কথা বা কর্মকাণ্ডে।তারা ভাবে আমি যেমন আমার পেশাগত দায়িত্বের মধ্যদিয়ে মানুষের সেবা ও দেশের জন্য অবদান রাখছি, অন্য প্রতিটি পেশার মানুষও তার অবস্থান থেকে মানুষের সেবা ও দেশের জন্য অবদান রাখছে।

সম্বোধনের ক্ষেত্রে, সম্বোধন সূচক শব্দটি চিকিৎসক এবং রোগী উভয়েরই এক,ছেলেদের ক্ষেত্রে মসিও,মেয়েদের ক্ষেত্রে মাদাম।রোগীর সামাজিক স্তর যেটাই হোকনা কেন।অর্থাৎ রোগী এই দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারে আবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মী হতে পারে।এ ক্ষেত্রে সম্মান সূচক সম্বোধনের বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না।ডাক্তার এবং রোগী একই সম্মান সূচক শব্দে একে অপরকে সম্বোধন করবে।মসিও অর্থ স্যার,মাদাম অর্থ ম্যাডাম।তবে পেশাগত কাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে ফরাসি জনগণ ডাক্তার এবং নার্সদের অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে থাকে। 

এখানকার ডাক্তার মনে করে রোগী অর্থ প্রদান করে আমার কাছে চিকিৎসা সেবা নিতে এসেছে সুতরাং আমার সর্বচ্চো পেশাগত সেবা নিশ্চিতের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে।

ডক্টর চেম্বারে নেয়া এপয়েন্টমেন্টের নির্ধারিত সময় কখনো কোন চিকিৎসক ইচ্ছে করলেই কোন বিশেষ মানুষের জন্য পরিবর্তন করতে পারবেনা। বিশেষ কারণে পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই ডাক্তার তার রোগীকে কারণ দর্শীয়ে অনুরোধ করবে। 

রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে  ডাক্তার রোগীর সমস্যাগুলো অতি যত্নের সহিত শুনে ব্যবস্থা পত্র লিখবে।প্রয়োজন হলে আরও বেশী সময় ব্যয় করবে,পরবর্তী রোগী দেখার জন্য কখনোই তাড়াহুড়া করবেনা।   

এখানকার জীবন যাপনে এগুলো খুবই সাধারণ বিষয়।তবে নিজের বাস্তব বিপদে পড়া এক রাতের  গল্পের ভেতর দিয়ে এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা বোঝাতে চাই। 


২০১৪ সালের শেষের দিকে  আমার স্ত্রী সন্তান বাংলাদেশ থেকে নতুন এসেছে।চলছে এখানকার 

খাবার -দাবার ও আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেবার চেষ্টা।আমরা প্যারিসের মঁনমার্ত এ Montmartre একটি স্টুডিও বাসায় ভাড়া থাকি।প্যারিস তখন প্রশাসনিক সতর্কতার নগরী।কারণ ৭ জানুয়ারি ২০১৫ ব্যাঙ্গত্বক ম্যাগাজিন শার্লি এবডো’র অফিসে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সহ ১২ জনকে। হামলা চালায় ইহুদী মালিকানাধীন সুপার মার্কেটে।ফলে প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে চলছে ফরাসি প্রশাসনের অতিরিক্ত নজরদারি।আমার বাসা প্যারিসের অন্যতম পর্যটন নিদর্শন সাক্রে ক্রোর বাসিলিকা Sacré-Cœur Basilica (খ্রিস্ট ধর্মীয় গির্জা) পাশে।এই ঘটনার কিছুদিন পর আমার বাসার নিচ তলার স্থাপন করা হয় ফ্রেঞ্চ আর্মির এক সেকশনের একটি সেনা ক্যাম্প।আমার ধারণা, এখানে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের দুটি কারণ ছিল, প্রথমত আমরা যে প্রতিষ্ঠানের বাসায় ভাড়া থাকি, প্রতিষ্ঠানটি ইহুদী কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত, দ্বিতীয়ত এই এলাকাটি প্যারিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। এই এলাকায় সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বিবেচনা করেই সার্বক্ষণিক সেনা নজরদারীর আওতায় এনে বিশেষ নিরাপত্তায় জোরদার করা হয়।প্যারিসে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারির হামলার রেশ না কাটতেই একই বছরের ১৩ নভেম্বর ঘটে আর একটি নারকীয় ঘটনা।যা ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বার রেস্তোরা, কনসার্ট হলসহ অন্তত ছয়টি স্থানে একযোগে হামলা  চালিয়ে ১২৭ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। আটজন হত্যাকারীও নিহত হয় যার মধ্যে সাতজনই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয়। 


১৩ নভেম্বরের শুক্রবার,  ফ্রান্স জার্মানীর প্রীতি ফুটবল ম্যাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো প্যারিস এ্যাটাক।একটু অবিশ্বাসবোধ নিয়ে ফরাসি ভাষায় বোঝার চেষ্টা করছিলাম কি ঘটেছে।ফ্রান্স জার্মানির কাছে ২-০ গোলে ম্যাচ জিতেছে কিন্তু ম্যাচ পরবর্তী খেলার বিশ্লেষন, পুরস্কার বিতরণী,দর্শকদের বিজয় উল্লাসের কোন মুহুর্ত আর টেলিভিশনের প্রচার  না দেখে মনে হলো সত্যি প্যারিসের বুকে কোন অশুভ তান্ডব চলছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় ভেসে আসতে লাগলো ঘটে যাওয়া নির্মমতার বাস্তব চিত্র এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা।যা দেখে মনে হচ্ছিলো রোমাঞ্চোকর নগরী যেন রনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।মনের মধ্যে কিছুটা আশংকাবোধ কাজ করছিলো কারণ প্যারিসের গুরত্বপূর্ণ জনবহুল স্থান ও এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় একের পর এক মৃত্যুর সংখ্যা গননা করে টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ পরিবেশন করে চলছে।

এই ঘটনার পর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর প্রথমবারের মত সারা দেশ জুড়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল কলেজ ও সকল পর্যটনস্থান। পুলিশ বাহিনীকে দেয়া হয় বিশেষ ক্ষমতা। 


প্যারিসে শুরু হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি।যেটা পূর্বে কখন ছিলনা।প্যারিস এমন এক নগরী যে শহরে এই দেশের বৈধ অবৈধ উভয় শ্রেণির মানুষ অবাধে বিচরণ করতে পারে। আমার এত বছরের  প্যারিসে বসবাসরত জীবনে পুলিশ কখন পরিচয়পত্র চেক করেনি, কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পর আমার বাসার সামনে চারজন সিভিল পুলিশ আমাকে তাদের পরিচয় দেখিয়ে আমার পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বলে।আমি তাদের দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমার পরিচয় দেখানোর পর মেরছি/ধন্যবাদ বলে ছেড়ে দেয়।একটি সন্দেহের নগরীতে পরিণত হয়েছিল প্যারিস।আমার বাসার নিচে ও আশেপাশে সেনা প্রহরা আরও জোরদার করা হয়।আমরা প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাইরে ঘুরতে যেতাম না। মাঝে মাঝে স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে পর্যটন স্থানগুলোতে ঘুরতে যেতাম, তা একেবারে বন্ধ করে দিলাম।ডিসেম্বরের শেষের দিকের  এক মধ্যরাতে আমার মেয়ে মিশেল ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বমি করা শুরু করল।কিছুক্ষণ বমি করার পর আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু পনের বিশ মিনিট পর আবার বিছানায় বসে বমি করে। এভাবে প্রায় পাঁচবার বমি করল।রাত প্রায় দুটো বাজে , আমাদের দুজন গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম।হঠাৎ করে কেন এমন হল? সারাদিন স্কুল করেছে। বাসায় এসে অন্যান্য দিনের মত খেলাধুলা করেছে, কোন অসুস্থতাবোধ চোখে পড়েনি। কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা।জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নম্বরে ফোন দেব কিন্তু আমার ফরাসি ভাষা জ্ঞান তখন খুব দুর্বল অবস্থায় যা দিয়ে ভালোভাবে ওদেরকে বোঝান সম্ভব নয়।বাচ্চার সমস্যা নিয়ে এই গভীর চিন্তার মধ্যে আমার স্ত্রী জান্নাত সেও বমি করতে শুরু করল।তারও একই অবস্থা, দশ মিনিট পর পর বমি করতে লাগলো। দারুণ এক সংকটময় মুহূর্ত তৈরি হল। কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে আমি এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলাম।আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় অভ্যরথনা কক্ষে নৈশ প্রহরায় রয়েছেন একজন সেনা কর্মকর্তা। আমি তাকে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার সংমিশ্রণে সমস্যা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোক বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নম্বরে তার অফিশিয়াল ফোন থেকে কল করলেন ।পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের প্রবেশদ্বারের সামনে এম্বুলেন্স চলে এলো।এম্বুলেন্স রাস্তায় পার্ক করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেবার জন্য দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করলো।সবকিছু শুনে ও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তারা দ্রুত হসপিটালে নেবার সিদ্ধান্ত নিলো, আমাকেও সঙ্গে যেতে বলল।ইতোমধ্যে দুজনই বমি করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মেয়েকে আমি কোলে করলাম এবং আমার স্ত্রী ধীরে ধীরে হেঁটে এম্বুলেন্সে গিয়ে বসল।এম্বুলেন্স হসপিটালের উদ্দেশে রওনা হল, কিন্তু কোন হসপিটালে যাচ্ছে আমরা তা জানিনা। এম্বুলেন্সের একজন স্বাস্থ্যকর্মী দুজনকে দুটো কাগজের বমি করার পাত্র দিলো। এম্বুলেন্স ঘুমিয়ে পড়া নিস্তব্ধ শহরের পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে দুজন বমি বমি করতে করতে আরও নেতিয়ে পড়ছে আর আমার মধ্যে দুশ্চিন্তার মেঘ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।চালকের পাশে বসা স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের সিএমইউ বা স্বাস্থ্যবীমার কাগজ দেখতে চাইল। আমি ডকুমেন্টটি তাকে দেবার পর ডকুমেন্টেরের মেয়াদের তারিখ পরীক্ষা করে পুনরায় আমাকে ফেরত দিলেন। এরমধ্যে এম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল একটি হসপিটালের সামনে।এম্বুলেন্স থেকে আমাকে এবং মিশেলকে নামিয়ে নিয়ে গেলো হসপিটালের অভ্যর্থনা কক্ষে। ডেস্কে কর্মরত কর্মীর কাছে আমাদের দুজনকে বুঝিয়ে দিয়ে লোকটি চলে গেলো।বুঝতে পারলাম না জান্নাতকে কেন এই হসপিটালে ভর্তি করা হলনা।সে এই দেশে নতুন মানুষ, তার উপর ভাষা জানে।তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হল, একা একা কিভাবে সবকিছু সামলাবে এই ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। অভ্যরথনা ডেস্কের প্রক্রিয়া শেষ করার পর মিশেল ও আমাকে বসতে বলা হল পাশের অপেক্ষমাণ কক্ষে।এখানে আমার মত আরও অনেক মানুষ অসুস্থ শিশু নিয়ে ডাক্তারের অপেক্ষায় রয়েছেন। বুঝতে পারলাম এটি শিশু হসপিটাল।হসপিটালের নাম  অপিতাল রবার্ট দো ব্রে।প্যারিসের  ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত।ডাক্তারের সাক্ষাতের অপেক্ষায় প্রায় এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলো।এরমধ্যে মিশেল বেশ কয়েকবার বমি করে ফেলেছে। মিশেলের মত আরও কয়েকটি শিশু একই ভাবে বমি করছে। একটি শিশু বমি করতে করতে ফ্লোরে গড়াগড়ি শুরু করে দিলো।মনে হল এটি সিজনাল ভাইরাস জনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। ভাবলাম হয়তো স্বাস্থ্যকর্মীরা জান্নাতকে এরমধ্যে অন্য হসপিটালে নিয়ে গেছে। তাই পরিস্থিতি জানার জন্য ওকে ফোন দিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ পেলাম।একটু চিন্তা হল আবার মনে হল হয়তো ডাক্তারের কাছে রয়েছে এজন্য ফোন বন্ধ রেখেছে।অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে আমাদের সিরিয়াল নম্বর মনিটরে ভেসে উঠলো। মিশেলকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করলাম। এক তরুণ ডাক্তার সমস্যা শুনে ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মিশেলকে একটা ঔষধ খাইয়ে দিলো এবং একটি প্রেসক্রিপশন লিখে ঔষধগুলো নিয়ম অনুযায়ী খাওয়াতে বলল। আশ্বস্ত করলো, ভয়ের কোন কারণ নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। 


ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর মিশেল আর বমি করলো না। ভোর পাঁচটা বাজে আমরা দুজন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম।আবারো জান্নাতের নম্বরে ফোন করলাম কিন্তু ফোন বন্ধ পেলাম। চিন্তা করছি, বেচারি কোথায় আছে? কিভাবে আছে ? তা একেবারেই অজানা। এই অন্ধকার রাতে মিশেলকে সাথে নিয়ে কোন হসপিটালে যাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ রাতভর বমি করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও রাস্তায় আমার সাথে হাঁটছে আর সুস্থ মানুষের মত কৌতূহলী নানা প্রশ্ন করছে। মনে হচ্ছে ওর কিছুই হয়নি। ভোর পাঁচটা ত্রিশ মিনিট থেকে মেট্রো ট্রেন সার্ভিস চালু হয় । আমরা পোর্ট  দ্যে লীলা এসে পনেরো মিনিট ট্রেনের অপেক্ষা করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভাবলাম, বাসায় পৌঁছে মিশেলকে খাইয়ে দাইয়ে ওর বন্ধু মারিয়ানাদের বাসায় রেখে জান্নাতকে খুঁজতে বের হবো।সকাল সাড়ে ছটায় বাসায় বাসায় এসে দেখি জান্নাত বাসায়। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার তোমাকে ফোনে পেলাম না, সামগ্রীক অবস্থা বল। ও বলল, ফোন বাসায় ছিল এবং ফোনে কোন চার্জ ছিল না আর এম্বুলেন্স আমাকে দ্রুত সেন্ট-ওয়া’র কাছের একটি হসপিটালে নিয়ে যায়। ওখানে জরুরি বিভাগের ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ঔষদ খাইয়ে বমি করা বন্ধ করে। পরে ডাক্তার বললেন, চিন্তার কোন কারণ নেই প্রেসক্রিপশনের ঔষদগুলো নিয়ম করে খাবেন, এখন একাই বাসায় চলে যেতে পারবেন আশা করি।পরে হসপিটাল থেকে মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে বাসায় চলে এসেছি। 

হতাশা ও দুশ্চিন্তার রাত পাড়ি দিয়ে পরের দিন ভোরের রাঙা সূর্যের আলোয় নতুন দিন শুরু হলো আমাদের। ঔষদ খেয়ে দুজনই সুস্থ হয়ে উঠলো।

 

ভেতরে কৃতজ্ঞতা বোধ অনুভব হল, এই বিপদে আমার কোন বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের প্রয়োজন পড়ে নাই। এম্বুলেন্স সার্ভিসের জন্য বিশেষ কোন ভিআইপি মানুষের রেফারেন্স প্রয়োজন হয়নি। শুধু আমি এই ভূখণ্ডের বিপদগ্রস্ত মানুষ, এই খবর শুনে গভীর রাতে ছুটে এসেছে স্বাস্থ্যকর্মীর গাড়ী। তারা যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের হসপিটালে নিয়ে গেলো, এর জন্য তারা কখনো আমাদের প্রশ্ন করে জানতে চাননি, আপনাদের পেশা কি? শিক্ষা কি ? কোন দেশের মানুষ ? যখন আমার এবং মিশেলকে এক হসপিটালে রেখে জান্নাতকে অন্য হসপিটালে নিয়ে গেলো তখন আমার মধ্য কোন নিরাপত্তা শঙ্কা জাগেনি,কারণ সেই আস্থা রয়েছে এই দেশের আইন ও পেশাদারিত্বের উপর। জান্নাতের মুখে সব বিবরণ শুনে সেই আস্থা আরও বেড়ে গেলো।ওই রাতে যদি হেলিকপ্টার প্রয়োজন হতো,তাহলে ওদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য হেলিকপ্টার নামত আমাদের বিল্ডিঙয়ের ছাদে। জীবনের মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে এই রাষ্ট্র এভাবেই মানুষের পাশে থাকে সব সময়। বিপদগ্রস্ত মানুষটির পকেটে  চিকিৎসা ব্যয়ের অর্থ আছে কিনা, সেটা পরে বিবেচ্য। প্রথমে জীবন, পরে অর্থ।   

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৮)  

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৮)

আমরা জানি, নিজের জীবন বিসর্জন দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন সৈনিকের।দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তার জীবন যে কোন মুহূর্তে উৎসর্গিত হতে পারে এটা জেনেই একজন মহৎ সাহসী তরুণ তরুণী সৈনিকের পোশাক গায়ে পরিধান করেন।সামনে শত্রু,তাদের রুখতে হলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে,বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারে শরীর,পৃথিবীর আলো বাতাস হয়তোবা এ জীবনে আর নাও জুটতে পারে, এসব ভাবনাকে তুচ্ছ করে একজন সৈনিক দেশের জনগণের স্বার্থে শত্রু ঘাঁটি  ধ্বংসের লক্ষ্যে এগিয়ে যায় পেশাগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে।যে জীবন অন্যের রক্ষার কাজে নিয়োজিত,এর থেকে মহৎ জীবন আর কার হতে পারে।এমন জীবনের অধিকারী মানুষ জীবিত অথবা মৃত উভয় অবস্থায় সম্মানিত। 


চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও তাদের সহযোগীদের পেশাগত দায়িত্ব মানুষের সেবা শুশ্রূষা দিয়ে অসুস্থতার কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেয়া।আমরা বলে থাকি এটি একটি মহান পেশা।কিন্তু এই মহত্ত্বের গভীরতা বা সীমারেখা যে কতটা সুদূর প্রসারী, তা নিবিড় ভাবে অনুধাবনের সুযোগ খুব কম আসে।আমার ব্যক্তিগত মতামত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পেশাগত মহত্ত্বের সীমারেখা অসীম।কারণ,মানুষ একটি জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে।দুইবারের জন্য নয়।সেই জীবনকে সে সুস্থতার সহিত রোগভোগ মুক্তভাবে পরিবাহিত করতে চায়। কিন্তু ধূলা ময়লা,জীবাণু ভরা প্রাণ প্রকৃতি,যুদ্ধ বিগ্রহ,একে অন্যের দ্বারা নৃশংস হামলা,ভেজাল খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ,বার্ধক্য সহ নানা কারণে রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করতে হয় আমাদের।জীবনের এমন কঠিন ও ভয়াবহ সময়ে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের শিয়রের পাশের এসে দাঁড়ায় কোন চিকিৎসক।তাদের অর্জিত জ্ঞানের আলোকে পরামর্শ ও সেবা নিয়ে সুস্থ সবল হয়ে উঠি।নবজীবন নিয়ে আবার এই ধরণীর আলো বাতাসের স্বাদ উপভোগ করি আমরা।


একজন চিকিৎসকের  ব্যক্তিগত জীবন অন্য সবার মত।সেও নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য নিরাপদ জীবন যাপন করতে চান। কিন্তু একজন চিকিৎসক,নার্স ও তাদের সহযোগীদের কখনো কখনো একজন সৈনিকের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া লাগতে পারে,তা আমরা এতদিন গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখিনি।কিন্তু সময়ের বাস্তবতায় আমাদের আজ সেভাবে দেখতে হচ্ছে। 


১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে।এই যুদ্ধে  একদেশ অন্যদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না।এই যুদ্ধে নেই কোন বোমারু বিমান,রাইফেল, গোলাবারুদের ব্যবহার।এই যুদ্ধের সৈনিকদের পরতে হচ্ছেনা চক্রবক্র সমর পোশাক ও ভারি হেলমেট।কারণ এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ অদৃশ্যমান একটি ভয়ংকর শক্তিশালী জীবাণু,নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯।যা দৃশ্যমান গোলাবারুদের চেয়োও ভয়ংকর।কারণ এর তাৎক্ষণিক আক্রমণ প্রতিহতের কৌশল মানুষের আজ অজানা।এক মাত্র কৌশল, সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে পথচলা। মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে তার আবির্ভাব।শুধু একজন জীবাণুবাহী মানুষের স্পর্শ অন্যের জীবনকে বিপন্নের সম্মুখীন করতে সক্ষম এই জীবাণু।আর এভাবেই তার আগ্রাসী বিচরণ আজ সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে।এপ্রিল ২০২০ এর মধ্যেই এই অদৃশ্য শত্রুর দানবীয় আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ। হসপিটালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাটছে অনেক মানুষের জীবন।যাদের শরীরে অবস্থান নিয়েছে এই অদৃশ্য দানব তাদের দিন কাটছে মৃত্যু আতংকে। ভীতির কারণে থমকে গেছে অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা। চীনের উহান,ইতালির জনপদকে করেছে ভূতুড়ে বিরানভূমি, ফ্রান্স,ইংল্যান্ড,আমেরিকা ও স্পেনে এই সময়ে চলছে নৃশংস তাণ্ডব।এখন  কারো ভাবনায়, করোনা আগ্রাসন পরবর্তী পৃথিবীতে সুযোগ মিলবে কি নতুন করে বেঁচে থাকার?  পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সরকার তাদের জনগণকে রক্ষার জন্য করেছে গৃহবন্দী এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইচ্ছে করলেই যে কেউ সমরের ঝুঁকিপূর্ণ অগ্রভাগে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।কারণ এই যুদ্ধের অগ্রভাগের  সৈনিক হতে পারবে তারাই যারা চিকিৎসা বিদ্যায় জ্ঞান অর্জনকারী বিশেষ মানুষ।অর্থাৎ, ডাক্তার এবং নার্স।পৃথিবীর মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাসের যে লড়াই চলছে, সেই লড়াইয়ে মানুষের জয় নিশ্চিত করতে আমাদের সাধারণ মানুষকে পেছনে রেখে অগ্রভাগে অবস্থান নিয়েছে ডাক্তার ও নার্স পেশার সময়ের সাহসী মানুষেরা।চলছে বিরতিহীন যুদ্ধ,ভয়াবহ এই সমরে বিরামহীন ভাবে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা তাদের।ক্লান্ত দেহ তবুও মস্তিষ্ক ও দেহের সবটুকু উজাড় করে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাবার আত্মপ্রত্যয়ে শত্রুকে পরাস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা। 


আমি একজন ফ্রাঙ্কোবাংলাদেশী।প্রায় দশ বছর ধরে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস।ফ্রান্স সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, ফরাসি ভূখণ্ড হল মানবতার চারণভূমি।এই দেশে বসে স্বচক্ষে যেভাবে দেখছি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফ্রান্স প্রশাসনের লড়াইয়ের কৌশল ও রণাঙ্গনে টিকে থাকার সংগ্রামে শক্তির ব্যবহার, তার আলোকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিজের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীকে অনুভূত হয়েছে উল্লেখিত বর্ণনার মত।কিন্তু,প্রকৃত সত্য এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত দেশের লড়াইয়ের ধরণ, কৌশল একই ভাবে চলছেনা। এটা নির্ভর করছে ওই দেশের জনসংখ্যা,আর্থিক সক্ষমতা,রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সমাজ ব্যবস্থা,জাতি গোষ্ঠীর মানুষের চিন্তাধারা  ইত্যাদির উপর।

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)