শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৯)

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াই কৌশলের বর্ণনা পূর্বে এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা একটু বর্ণনা করে নিলে অনুধাবন করতে অনেকটা সহজ হবে। 

অনেক ছোটোখাটো শারীরিক সমস্যায় অনেকবার এখানকার ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছি।আমি জীবনের অধিকাংশ সময় জন্মভূমি বাংলাদেশে অতিবাহিত করে এসেছি,ফলে আমার কাছে নিজের জন্মভূমির রীতিনীতি ও সমাজ সংস্কৃতির সাথে ফ্রান্সের পার্থক্যটা খুব সহজেই ধরা পরে।পার্থক্যগুলো ফরাসি জীবন ধারায় স্বাভাবিক হলেও আমার কাছে বিশেষ। 

 প্রথমত আমি লক্ষ্য করেছি ,এখানকার ডাক্তাররা মনে করে না,তিনি একটি বিশেষ পেশার মানুষ।তাদের আচরণে প্রকাশ পায়, তার পেশাটা সমাজের অন্যান্য পেশার মতই একটি সাধারণ পেশা।তাই অন্য যে কোন পেশার  মানুষদের সাথে  যখন মিলিত হয় তখন পেশাগত অহংকার বা দম্ভ ফুটে ওঠেনা তাদের কথা বা কর্মকাণ্ডে।তারা ভাবে আমি যেমন আমার পেশাগত দায়িত্বের মধ্যদিয়ে মানুষের সেবা ও দেশের জন্য অবদান রাখছি, অন্য প্রতিটি পেশার মানুষও তার অবস্থান থেকে মানুষের সেবা ও দেশের জন্য অবদান রাখছে।

সম্বোধনের ক্ষেত্রে, সম্বোধন সূচক শব্দটি চিকিৎসক এবং রোগী উভয়েরই এক,ছেলেদের ক্ষেত্রে মসিও,মেয়েদের ক্ষেত্রে মাদাম।রোগীর সামাজিক স্তর যেটাই হোকনা কেন।অর্থাৎ রোগী এই দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারে আবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মী হতে পারে।এ ক্ষেত্রে সম্মান সূচক সম্বোধনের বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না।ডাক্তার এবং রোগী একই সম্মান সূচক শব্দে একে অপরকে সম্বোধন করবে।মসিও অর্থ স্যার,মাদাম অর্থ ম্যাডাম।তবে পেশাগত কাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে ফরাসি জনগণ ডাক্তার এবং নার্সদের অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে থাকে। 

এখানকার ডাক্তার মনে করে রোগী অর্থ প্রদান করে আমার কাছে চিকিৎসা সেবা নিতে এসেছে সুতরাং আমার সর্বচ্চো পেশাগত সেবা নিশ্চিতের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে।

ডক্টর চেম্বারে নেয়া এপয়েন্টমেন্টের নির্ধারিত সময় কখনো কোন চিকিৎসক ইচ্ছে করলেই কোন বিশেষ মানুষের জন্য পরিবর্তন করতে পারবেনা। বিশেষ কারণে পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই ডাক্তার তার রোগীকে কারণ দর্শীয়ে অনুরোধ করবে। 

রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে  ডাক্তার রোগীর সমস্যাগুলো অতি যত্নের সহিত শুনে ব্যবস্থা পত্র লিখবে।প্রয়োজন হলে আরও বেশী সময় ব্যয় করবে,পরবর্তী রোগী দেখার জন্য কখনোই তাড়াহুড়া করবেনা।   

এখানকার জীবন যাপনে এগুলো খুবই সাধারণ বিষয়।তবে নিজের বাস্তব বিপদে পড়া এক রাতের  গল্পের ভেতর দিয়ে এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা বোঝাতে চাই। 


২০১৪ সালের শেষের দিকে  আমার স্ত্রী সন্তান বাংলাদেশ থেকে নতুন এসেছে।চলছে এখানকার 

খাবার -দাবার ও আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেবার চেষ্টা।আমরা প্যারিসের মঁনমার্ত এ Montmartre একটি স্টুডিও বাসায় ভাড়া থাকি।প্যারিস তখন প্রশাসনিক সতর্কতার নগরী।কারণ ৭ জানুয়ারি ২০১৫ ব্যাঙ্গত্বক ম্যাগাজিন শার্লি এবডো’র অফিসে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সহ ১২ জনকে। হামলা চালায় ইহুদী মালিকানাধীন সুপার মার্কেটে।ফলে প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে চলছে ফরাসি প্রশাসনের অতিরিক্ত নজরদারি।আমার বাসা প্যারিসের অন্যতম পর্যটন নিদর্শন সাক্রে ক্রোর বাসিলিকা Sacré-Cœur Basilica (খ্রিস্ট ধর্মীয় গির্জা) পাশে।এই ঘটনার কিছুদিন পর আমার বাসার নিচ তলার স্থাপন করা হয় ফ্রেঞ্চ আর্মির এক সেকশনের একটি সেনা ক্যাম্প।আমার ধারণা, এখানে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের দুটি কারণ ছিল, প্রথমত আমরা যে প্রতিষ্ঠানের বাসায় ভাড়া থাকি, প্রতিষ্ঠানটি ইহুদী কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত, দ্বিতীয়ত এই এলাকাটি প্যারিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। এই এলাকায় সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বিবেচনা করেই সার্বক্ষণিক সেনা নজরদারীর আওতায় এনে বিশেষ নিরাপত্তায় জোরদার করা হয়।প্যারিসে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারির হামলার রেশ না কাটতেই একই বছরের ১৩ নভেম্বর ঘটে আর একটি নারকীয় ঘটনা।যা ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বার রেস্তোরা, কনসার্ট হলসহ অন্তত ছয়টি স্থানে একযোগে হামলা  চালিয়ে ১২৭ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। আটজন হত্যাকারীও নিহত হয় যার মধ্যে সাতজনই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয়। 


১৩ নভেম্বরের শুক্রবার,  ফ্রান্স জার্মানীর প্রীতি ফুটবল ম্যাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো প্যারিস এ্যাটাক।একটু অবিশ্বাসবোধ নিয়ে ফরাসি ভাষায় বোঝার চেষ্টা করছিলাম কি ঘটেছে।ফ্রান্স জার্মানির কাছে ২-০ গোলে ম্যাচ জিতেছে কিন্তু ম্যাচ পরবর্তী খেলার বিশ্লেষন, পুরস্কার বিতরণী,দর্শকদের বিজয় উল্লাসের কোন মুহুর্ত আর টেলিভিশনের প্রচার  না দেখে মনে হলো সত্যি প্যারিসের বুকে কোন অশুভ তান্ডব চলছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় ভেসে আসতে লাগলো ঘটে যাওয়া নির্মমতার বাস্তব চিত্র এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা।যা দেখে মনে হচ্ছিলো রোমাঞ্চোকর নগরী যেন রনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।মনের মধ্যে কিছুটা আশংকাবোধ কাজ করছিলো কারণ প্যারিসের গুরত্বপূর্ণ জনবহুল স্থান ও এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় একের পর এক মৃত্যুর সংখ্যা গননা করে টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ পরিবেশন করে চলছে।

এই ঘটনার পর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর প্রথমবারের মত সারা দেশ জুড়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল কলেজ ও সকল পর্যটনস্থান। পুলিশ বাহিনীকে দেয়া হয় বিশেষ ক্ষমতা। 


প্যারিসে শুরু হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি।যেটা পূর্বে কখন ছিলনা।প্যারিস এমন এক নগরী যে শহরে এই দেশের বৈধ অবৈধ উভয় শ্রেণির মানুষ অবাধে বিচরণ করতে পারে। আমার এত বছরের  প্যারিসে বসবাসরত জীবনে পুলিশ কখন পরিচয়পত্র চেক করেনি, কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পর আমার বাসার সামনে চারজন সিভিল পুলিশ আমাকে তাদের পরিচয় দেখিয়ে আমার পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বলে।আমি তাদের দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমার পরিচয় দেখানোর পর মেরছি/ধন্যবাদ বলে ছেড়ে দেয়।একটি সন্দেহের নগরীতে পরিণত হয়েছিল প্যারিস।আমার বাসার নিচে ও আশেপাশে সেনা প্রহরা আরও জোরদার করা হয়।আমরা প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাইরে ঘুরতে যেতাম না। মাঝে মাঝে স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে পর্যটন স্থানগুলোতে ঘুরতে যেতাম, তা একেবারে বন্ধ করে দিলাম।ডিসেম্বরের শেষের দিকের  এক মধ্যরাতে আমার মেয়ে মিশেল ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বমি করা শুরু করল।কিছুক্ষণ বমি করার পর আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু পনের বিশ মিনিট পর আবার বিছানায় বসে বমি করে। এভাবে প্রায় পাঁচবার বমি করল।রাত প্রায় দুটো বাজে , আমাদের দুজন গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম।হঠাৎ করে কেন এমন হল? সারাদিন স্কুল করেছে। বাসায় এসে অন্যান্য দিনের মত খেলাধুলা করেছে, কোন অসুস্থতাবোধ চোখে পড়েনি। কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা।জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নম্বরে ফোন দেব কিন্তু আমার ফরাসি ভাষা জ্ঞান তখন খুব দুর্বল অবস্থায় যা দিয়ে ভালোভাবে ওদেরকে বোঝান সম্ভব নয়।বাচ্চার সমস্যা নিয়ে এই গভীর চিন্তার মধ্যে আমার স্ত্রী জান্নাত সেও বমি করতে শুরু করল।তারও একই অবস্থা, দশ মিনিট পর পর বমি করতে লাগলো। দারুণ এক সংকটময় মুহূর্ত তৈরি হল। কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে আমি এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলাম।আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় অভ্যরথনা কক্ষে নৈশ প্রহরায় রয়েছেন একজন সেনা কর্মকর্তা। আমি তাকে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার সংমিশ্রণে সমস্যা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোক বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নম্বরে তার অফিশিয়াল ফোন থেকে কল করলেন ।পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের প্রবেশদ্বারের সামনে এম্বুলেন্স চলে এলো।এম্বুলেন্স রাস্তায় পার্ক করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেবার জন্য দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করলো।সবকিছু শুনে ও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তারা দ্রুত হসপিটালে নেবার সিদ্ধান্ত নিলো, আমাকেও সঙ্গে যেতে বলল।ইতোমধ্যে দুজনই বমি করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মেয়েকে আমি কোলে করলাম এবং আমার স্ত্রী ধীরে ধীরে হেঁটে এম্বুলেন্সে গিয়ে বসল।এম্বুলেন্স হসপিটালের উদ্দেশে রওনা হল, কিন্তু কোন হসপিটালে যাচ্ছে আমরা তা জানিনা। এম্বুলেন্সের একজন স্বাস্থ্যকর্মী দুজনকে দুটো কাগজের বমি করার পাত্র দিলো। এম্বুলেন্স ঘুমিয়ে পড়া নিস্তব্ধ শহরের পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে দুজন বমি বমি করতে করতে আরও নেতিয়ে পড়ছে আর আমার মধ্যে দুশ্চিন্তার মেঘ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।চালকের পাশে বসা স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের সিএমইউ বা স্বাস্থ্যবীমার কাগজ দেখতে চাইল। আমি ডকুমেন্টটি তাকে দেবার পর ডকুমেন্টেরের মেয়াদের তারিখ পরীক্ষা করে পুনরায় আমাকে ফেরত দিলেন। এরমধ্যে এম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল একটি হসপিটালের সামনে।এম্বুলেন্স থেকে আমাকে এবং মিশেলকে নামিয়ে নিয়ে গেলো হসপিটালের অভ্যর্থনা কক্ষে। ডেস্কে কর্মরত কর্মীর কাছে আমাদের দুজনকে বুঝিয়ে দিয়ে লোকটি চলে গেলো।বুঝতে পারলাম না জান্নাতকে কেন এই হসপিটালে ভর্তি করা হলনা।সে এই দেশে নতুন মানুষ, তার উপর ভাষা জানে।তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হল, একা একা কিভাবে সবকিছু সামলাবে এই ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। অভ্যরথনা ডেস্কের প্রক্রিয়া শেষ করার পর মিশেল ও আমাকে বসতে বলা হল পাশের অপেক্ষমাণ কক্ষে।এখানে আমার মত আরও অনেক মানুষ অসুস্থ শিশু নিয়ে ডাক্তারের অপেক্ষায় রয়েছেন। বুঝতে পারলাম এটি শিশু হসপিটাল।হসপিটালের নাম  অপিতাল রবার্ট দো ব্রে।প্যারিসের  ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত।ডাক্তারের সাক্ষাতের অপেক্ষায় প্রায় এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলো।এরমধ্যে মিশেল বেশ কয়েকবার বমি করে ফেলেছে। মিশেলের মত আরও কয়েকটি শিশু একই ভাবে বমি করছে। একটি শিশু বমি করতে করতে ফ্লোরে গড়াগড়ি শুরু করে দিলো।মনে হল এটি সিজনাল ভাইরাস জনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। ভাবলাম হয়তো স্বাস্থ্যকর্মীরা জান্নাতকে এরমধ্যে অন্য হসপিটালে নিয়ে গেছে। তাই পরিস্থিতি জানার জন্য ওকে ফোন দিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ পেলাম।একটু চিন্তা হল আবার মনে হল হয়তো ডাক্তারের কাছে রয়েছে এজন্য ফোন বন্ধ রেখেছে।অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে আমাদের সিরিয়াল নম্বর মনিটরে ভেসে উঠলো। মিশেলকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করলাম। এক তরুণ ডাক্তার সমস্যা শুনে ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মিশেলকে একটা ঔষধ খাইয়ে দিলো এবং একটি প্রেসক্রিপশন লিখে ঔষধগুলো নিয়ম অনুযায়ী খাওয়াতে বলল। আশ্বস্ত করলো, ভয়ের কোন কারণ নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। 


ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর মিশেল আর বমি করলো না। ভোর পাঁচটা বাজে আমরা দুজন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম।আবারো জান্নাতের নম্বরে ফোন করলাম কিন্তু ফোন বন্ধ পেলাম। চিন্তা করছি, বেচারি কোথায় আছে? কিভাবে আছে ? তা একেবারেই অজানা। এই অন্ধকার রাতে মিশেলকে সাথে নিয়ে কোন হসপিটালে যাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ রাতভর বমি করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও রাস্তায় আমার সাথে হাঁটছে আর সুস্থ মানুষের মত কৌতূহলী নানা প্রশ্ন করছে। মনে হচ্ছে ওর কিছুই হয়নি। ভোর পাঁচটা ত্রিশ মিনিট থেকে মেট্রো ট্রেন সার্ভিস চালু হয় । আমরা পোর্ট  দ্যে লীলা এসে পনেরো মিনিট ট্রেনের অপেক্ষা করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভাবলাম, বাসায় পৌঁছে মিশেলকে খাইয়ে দাইয়ে ওর বন্ধু মারিয়ানাদের বাসায় রেখে জান্নাতকে খুঁজতে বের হবো।সকাল সাড়ে ছটায় বাসায় বাসায় এসে দেখি জান্নাত বাসায়। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার তোমাকে ফোনে পেলাম না, সামগ্রীক অবস্থা বল। ও বলল, ফোন বাসায় ছিল এবং ফোনে কোন চার্জ ছিল না আর এম্বুলেন্স আমাকে দ্রুত সেন্ট-ওয়া’র কাছের একটি হসপিটালে নিয়ে যায়। ওখানে জরুরি বিভাগের ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ঔষদ খাইয়ে বমি করা বন্ধ করে। পরে ডাক্তার বললেন, চিন্তার কোন কারণ নেই প্রেসক্রিপশনের ঔষদগুলো নিয়ম করে খাবেন, এখন একাই বাসায় চলে যেতে পারবেন আশা করি।পরে হসপিটাল থেকে মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে বাসায় চলে এসেছি। 

হতাশা ও দুশ্চিন্তার রাত পাড়ি দিয়ে পরের দিন ভোরের রাঙা সূর্যের আলোয় নতুন দিন শুরু হলো আমাদের। ঔষদ খেয়ে দুজনই সুস্থ হয়ে উঠলো।

 

ভেতরে কৃতজ্ঞতা বোধ অনুভব হল, এই বিপদে আমার কোন বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের প্রয়োজন পড়ে নাই। এম্বুলেন্স সার্ভিসের জন্য বিশেষ কোন ভিআইপি মানুষের রেফারেন্স প্রয়োজন হয়নি। শুধু আমি এই ভূখণ্ডের বিপদগ্রস্ত মানুষ, এই খবর শুনে গভীর রাতে ছুটে এসেছে স্বাস্থ্যকর্মীর গাড়ী। তারা যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের হসপিটালে নিয়ে গেলো, এর জন্য তারা কখনো আমাদের প্রশ্ন করে জানতে চাননি, আপনাদের পেশা কি? শিক্ষা কি ? কোন দেশের মানুষ ? যখন আমার এবং মিশেলকে এক হসপিটালে রেখে জান্নাতকে অন্য হসপিটালে নিয়ে গেলো তখন আমার মধ্য কোন নিরাপত্তা শঙ্কা জাগেনি,কারণ সেই আস্থা রয়েছে এই দেশের আইন ও পেশাদারিত্বের উপর। জান্নাতের মুখে সব বিবরণ শুনে সেই আস্থা আরও বেড়ে গেলো।ওই রাতে যদি হেলিকপ্টার প্রয়োজন হতো,তাহলে ওদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য হেলিকপ্টার নামত আমাদের বিল্ডিঙয়ের ছাদে। জীবনের মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে এই রাষ্ট্র এভাবেই মানুষের পাশে থাকে সব সময়। বিপদগ্রস্ত মানুষটির পকেটে  চিকিৎসা ব্যয়ের অর্থ আছে কিনা, সেটা পরে বিবেচ্য। প্রথমে জীবন, পরে অর্থ।   

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৮)  

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৮)

আমরা জানি, নিজের জীবন বিসর্জন দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন সৈনিকের।দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তার জীবন যে কোন মুহূর্তে উৎসর্গিত হতে পারে এটা জেনেই একজন মহৎ সাহসী তরুণ তরুণী সৈনিকের পোশাক গায়ে পরিধান করেন।সামনে শত্রু,তাদের রুখতে হলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে,বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারে শরীর,পৃথিবীর আলো বাতাস হয়তোবা এ জীবনে আর নাও জুটতে পারে, এসব ভাবনাকে তুচ্ছ করে একজন সৈনিক দেশের জনগণের স্বার্থে শত্রু ঘাঁটি  ধ্বংসের লক্ষ্যে এগিয়ে যায় পেশাগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে।যে জীবন অন্যের রক্ষার কাজে নিয়োজিত,এর থেকে মহৎ জীবন আর কার হতে পারে।এমন জীবনের অধিকারী মানুষ জীবিত অথবা মৃত উভয় অবস্থায় সম্মানিত। 


চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও তাদের সহযোগীদের পেশাগত দায়িত্ব মানুষের সেবা শুশ্রূষা দিয়ে অসুস্থতার কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেয়া।আমরা বলে থাকি এটি একটি মহান পেশা।কিন্তু এই মহত্ত্বের গভীরতা বা সীমারেখা যে কতটা সুদূর প্রসারী, তা নিবিড় ভাবে অনুধাবনের সুযোগ খুব কম আসে।আমার ব্যক্তিগত মতামত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পেশাগত মহত্ত্বের সীমারেখা অসীম।কারণ,মানুষ একটি জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে।দুইবারের জন্য নয়।সেই জীবনকে সে সুস্থতার সহিত রোগভোগ মুক্তভাবে পরিবাহিত করতে চায়। কিন্তু ধূলা ময়লা,জীবাণু ভরা প্রাণ প্রকৃতি,যুদ্ধ বিগ্রহ,একে অন্যের দ্বারা নৃশংস হামলা,ভেজাল খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ,বার্ধক্য সহ নানা কারণে রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করতে হয় আমাদের।জীবনের এমন কঠিন ও ভয়াবহ সময়ে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের শিয়রের পাশের এসে দাঁড়ায় কোন চিকিৎসক।তাদের অর্জিত জ্ঞানের আলোকে পরামর্শ ও সেবা নিয়ে সুস্থ সবল হয়ে উঠি।নবজীবন নিয়ে আবার এই ধরণীর আলো বাতাসের স্বাদ উপভোগ করি আমরা।


একজন চিকিৎসকের  ব্যক্তিগত জীবন অন্য সবার মত।সেও নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য নিরাপদ জীবন যাপন করতে চান। কিন্তু একজন চিকিৎসক,নার্স ও তাদের সহযোগীদের কখনো কখনো একজন সৈনিকের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া লাগতে পারে,তা আমরা এতদিন গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখিনি।কিন্তু সময়ের বাস্তবতায় আমাদের আজ সেভাবে দেখতে হচ্ছে। 


১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে।এই যুদ্ধে  একদেশ অন্যদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না।এই যুদ্ধে নেই কোন বোমারু বিমান,রাইফেল, গোলাবারুদের ব্যবহার।এই যুদ্ধের সৈনিকদের পরতে হচ্ছেনা চক্রবক্র সমর পোশাক ও ভারি হেলমেট।কারণ এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ অদৃশ্যমান একটি ভয়ংকর শক্তিশালী জীবাণু,নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯।যা দৃশ্যমান গোলাবারুদের চেয়োও ভয়ংকর।কারণ এর তাৎক্ষণিক আক্রমণ প্রতিহতের কৌশল মানুষের আজ অজানা।এক মাত্র কৌশল, সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে পথচলা। মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে তার আবির্ভাব।শুধু একজন জীবাণুবাহী মানুষের স্পর্শ অন্যের জীবনকে বিপন্নের সম্মুখীন করতে সক্ষম এই জীবাণু।আর এভাবেই তার আগ্রাসী বিচরণ আজ সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে।এপ্রিল ২০২০ এর মধ্যেই এই অদৃশ্য শত্রুর দানবীয় আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ। হসপিটালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাটছে অনেক মানুষের জীবন।যাদের শরীরে অবস্থান নিয়েছে এই অদৃশ্য দানব তাদের দিন কাটছে মৃত্যু আতংকে। ভীতির কারণে থমকে গেছে অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা। চীনের উহান,ইতালির জনপদকে করেছে ভূতুড়ে বিরানভূমি, ফ্রান্স,ইংল্যান্ড,আমেরিকা ও স্পেনে এই সময়ে চলছে নৃশংস তাণ্ডব।এখন  কারো ভাবনায়, করোনা আগ্রাসন পরবর্তী পৃথিবীতে সুযোগ মিলবে কি নতুন করে বেঁচে থাকার?  পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সরকার তাদের জনগণকে রক্ষার জন্য করেছে গৃহবন্দী এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইচ্ছে করলেই যে কেউ সমরের ঝুঁকিপূর্ণ অগ্রভাগে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।কারণ এই যুদ্ধের অগ্রভাগের  সৈনিক হতে পারবে তারাই যারা চিকিৎসা বিদ্যায় জ্ঞান অর্জনকারী বিশেষ মানুষ।অর্থাৎ, ডাক্তার এবং নার্স।পৃথিবীর মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাসের যে লড়াই চলছে, সেই লড়াইয়ে মানুষের জয় নিশ্চিত করতে আমাদের সাধারণ মানুষকে পেছনে রেখে অগ্রভাগে অবস্থান নিয়েছে ডাক্তার ও নার্স পেশার সময়ের সাহসী মানুষেরা।চলছে বিরতিহীন যুদ্ধ,ভয়াবহ এই সমরে বিরামহীন ভাবে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা তাদের।ক্লান্ত দেহ তবুও মস্তিষ্ক ও দেহের সবটুকু উজাড় করে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাবার আত্মপ্রত্যয়ে শত্রুকে পরাস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা। 


আমি একজন ফ্রাঙ্কোবাংলাদেশী।প্রায় দশ বছর ধরে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস।ফ্রান্স সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, ফরাসি ভূখণ্ড হল মানবতার চারণভূমি।এই দেশে বসে স্বচক্ষে যেভাবে দেখছি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফ্রান্স প্রশাসনের লড়াইয়ের কৌশল ও রণাঙ্গনে টিকে থাকার সংগ্রামে শক্তির ব্যবহার, তার আলোকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিজের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীকে অনুভূত হয়েছে উল্লেখিত বর্ণনার মত।কিন্তু,প্রকৃত সত্য এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত দেশের লড়াইয়ের ধরণ, কৌশল একই ভাবে চলছেনা। এটা নির্ভর করছে ওই দেশের জনসংখ্যা,আর্থিক সক্ষমতা,রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সমাজ ব্যবস্থা,জাতি গোষ্ঠীর মানুষের চিন্তাধারা  ইত্যাদির উপর।

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৭ )

সমস্ত ফ্রান্সের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিন অবনতি হচ্ছে।মার্চের শেষের দিক থেকে পরিস্থিতি  অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। প্রথম দিকে  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক Jérome Saloman যখন প্রতিদিনের করোনা পরিস্থিতির পর্যালোচনা ও পরিসংখ্যান নিয়ে টেলিভিশন পর্দায় উপস্থিত হতেন তখন তার মুখের এককোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠত, কথায় আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা প্রকাশ পেত।কিন্তু এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে তার মুখে আর হাসি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা, মুখে ফুটে উঠে ক্লান্তি ও বিষণ্ণতার ছাপ।একটি নিম্ন জন্মহারের দেশে প্রতিদিন পাঁচ ছয়শত মানুষের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে হাজির হওয়া কোন স্বাভাবিক বিষয় নয়। এ সময় দেশের চিকিৎসক শ্রেণীর মধ্যে করোনা চিকিৎসা নিয়ে চলছে নানা পর্যালোচনা কিন্তু সঠিক সমাধান নেই কারো হাতে।ফরাসি সরকার দিশেহারা হয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে বার বার আলোচনায় বসছে।এর মধ্যে ফ্রান্সের মার্সেই শহরের Institut Hospitalo-Universitaire de Marseille এর পরিচালক প্রফেসর Didier Raoult  করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপর প্রায় সত্তর বছর ধরে ম্যালেরিয়া নির্মূলে ব্যবহৃত ক্লোরোকুইন প্রয়োগের পরামর্শ দেন।তিনি দাবী করেন, এক সপ্তাহে করোনা আক্রান্ত যেসব ব্যক্তির উপর এই ঔষধটি প্রয়োগ করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই সুস্থ হয়ে উঠছেন।তার এই মন্তব্যের পর, এই ঔষধটি করোনা নির্মূলের মোক্ষম ঔষধ হিসেবে ডাক্তাররা ব্যবহার করবে কিনা, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে ফ্রান্সের চিকিৎসক মহলে তর্ক বিতর্ক তুমুলে পৌঁছায়। এই সময়টাতে সমস্ত ফরাসি মিডিয়ার হিরো প্রফেসর দিদিয়ে রাউল।তিনি যেন অথৈই সমুদ্রের মাঝে দিকহারা ভাসমান তরির একমাত্র মাঝি। তার জীবনের  বিভিন্ন গবেষণা ও চলমান করোনা ভাইরাস নিয়ে পর্যালোচনার প্রতিবেদন প্রতিদিন কোননা কোন টিভি চ্যানেল প্রচার করছে। Nice শহরের মেয়র Estrosi করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়।তার শরীরে la chloroquine ব্যবহারের পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।সরকারী অনুমোদন না থাকলে তিনি তার শহরে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপর এই ঔষধটি প্রয়োগের ইচ্ছা পোষণ করেন। 

কয়েকদিনের তর্কবিতর্কের পর অবশেষে ফরাসি সরকার করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে la chloroquine ঔষধটিকে ডাক্তারদেরকে ব্যবস্থাপত্র লিখতে অনুমোদন দেয়।পরবর্তীতে যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক তাদের শরীরে এই ঔষধটি প্রয়োগ শুরু হয়।  

পহেলা এপ্রিল ২০২০, ফ্রান্সে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০৩২ জনে।


এ সময়ে ফ্রান্সের ইল্‌-দ্য-ফ্রঁস এলাকায় করোনা রুগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। হসপিটালের বেড,চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা কর্মী রুগীর তুলনায় সীমাবদ্ধতার কারণে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হতে থাকে। এই সমস্যা সমাধানকল্পে সরকারকে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হয়।এপ্রিলের শুরুতে ফ্রান্সের যে সব অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের হার কম এবং হসপিটালগুলোর ব্যস্ততা কম রয়েছে সেই সব অঞ্চলের হসপিটালগুলোতে ইল্‌-দ্য-ফ্রঁস থেকে রুগী হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ জন্য ফ্রান্সের  দ্রুত গতির ট্রেন টিজিভি’র বগীগুলোতে তৈরি করা হয় ভ্রাম্যমাণ হসপিটাল।বগীগুলো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে সজ্জিত করা হয়। কয়েকটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়। প্রত্যেকটি টিমে একজন করে  অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট-রেসিসিটিটার,একজন ইন্টার্নশীপ ডাক্তার,একজন অচেতন প্রক্রিয়াকরণ বিশেষজ্ঞ নার্স এবং তিনজন সাধারণ নার্সের সমন্বয়ে এই টিম গঠন করা হয়।নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের অনেক রুগীকে পশ্চিম ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলের অনেক হসপিটালে স্থানান্তর করা হয়।এই রুগী হস্তান্তর প্রক্রিয়া অভিযানে আরও যোগ দেয় ফ্রান্সের আর্মি এভিয়েশন, নেভী, ও বিমান বাহিনী। যারা হেলিকপ্টার ও নৌ জাহাজের মাধ্যমে ফ্রান্সের পার্শ্ববর্তী দেশ সুইজারল্যান্ড, জার্মানি,লুক্সেমবুর্গ ইত্যাদি দেশগুলোর হসপিটালে চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সের করোনা আক্রান্ত মানুষগুদের হস্তান্তর অব্যাহত রাখেন।জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে সংক্রমের হার বেশী থাকলেও মৃত্যুর হার ছিল কম। তাদের আগাম কিছু পদক্ষেপের কারণে ক্ষতির হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পেরেছিল।যে ব্যাপারে ফ্রান্স ছিল অনেকটাই পেছনে। জার্মানি এক সময় ফ্রান্সের ঘোর শত্রু হলেও এই বিপদের দিনে ফ্রান্সের মানুষের পাশে থেকে জার্মান সরকার সেবা দিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কখনো শত্রু হলে সে সারা জীবনের শত্রু নয়, কখনো পরম বন্ধুর হাতও বাড়িয়ে দিতে পারে।ফ্রান্সের এই সংকটময় সময়ে জার্মানরা তারই প্রমাণ রেখেছে এবং এটাই হওয়া উচিত। তবে এই মানুসিকতা অর্জনের জন্য দরকার শিক্ষা ও প্রজ্ঞা, যা পৃথিবীর শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত দেশগুলোর মানুষ এই মানুসিকতার উচ্চ স্তরে পৌছুতে পেরেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এই মানুসিকতার স্তর থেকে এখনো শত শত মাইল দূরে।তার প্রমাণ বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের বৈরী রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক।

 করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৬ )

প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।বাইরের খোলা বাতাসকেও এখন সন্দেহ হয়। টিভিতে আলোচনায় উঠে আসে একটি সাধারণ প্রশ্ন ,লক ডাউন চলছে, তবুও কেন বাড়ছে কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অনেকেই সন্দেহাতীত ভাবে প্রশ্ন করেন, ভাইরাস কি বাতাসেও উড়ছে? 

এমন পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেললাম।

সিদ্ধান্ত নিলাম বাইরে গিয়ে আর দৌড়াবো না। আমার বাসার বারান্দা বেশ লম্বা, প্রায় ২০ স্কয়ার ফিট। এখন থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় বারান্দার এপার ওপার একশত বার প্রদক্ষিণ করলেও কিছুটা ব্যায়ামের কাজ হবে।সেই ভাবেই শুরু হল নতুন করে সামনের লক ডাউনের দিনগুলো। বাইরে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিলাম। ঘরের মজুদ খাদ্য সামগ্রীও কমতে শুরু করেছে। হিসেব করে ব্যয় করছি। সুপার মার্কেটে যাওয়ার সাহস হয়না।কারণ,সুপার মার্কেটে চাকুরী করা অনেক ক্যাশিয়ার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া গেছে।এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের আরও কঠোর ভাবে গৃহবন্দী করার সংকল্প করলাম। 


প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে বাবার উদ্বিগ্নতায় ভরা কণ্ঠ ফোনে ভেসে আসে।অনেক পরিচিত বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী ফেচবুক মেসেঞ্জারে আমাদের খোঁজ খবর নেয়।অবাদ তথ্য প্রবাহের যুগে অন্য দেশের খবরাখবর জানা এখন আর অসাধ্য নয়। প্রতিদিন ক্রিকেট স্কোর বোর্ডের মত প্রতিটি দেশের করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর প্রচার হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে।এপ্রিলের মাসের দিকে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় কাটাছে ইতালি, স্পেন এবং ফ্রান্স।এই সব দেশে থাকা প্রতিটি প্রবাসীর আত্মীয় স্বজনরাই দুশ্চিন্তার সময় পার করছে  দূরের স্বজনদের নিয়ে।এদিকে আমরা এখানে শুধু টেলিফোনে কথা বলা ছাড়া পরিচিতজনদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সময় পার করছি।

পরিবেশ অনেকটা এমন, চারদিকে অথৈ পানি, কোন এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আমাদের বসবাস।ভেতরে আতংক।বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রাণনাশী শত্রু।কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত নির্জন জনপদে প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে আছি আমরা।আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির মানুষদের প্রকৃত অবস্থা কি তার সঠিক তথ্য কারো কাছে নেই।ফেচবুকের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পেজ থেকে কিছু ভাসা  ভাসা খবর ভেসে আসে।আমাদের একান্ত পরিচিত বন্ধুদের খবরা খবর রাখার এক মাত্র অবলম্বন টেলিফোন।

সংস্কৃতি অনুরাগী হাসনাত জাহান আপা আমাদের প্রিয়জন।সত্তরের দশকের শেষের দিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসেছিলো এই ভূখণ্ডে।চল্লিশ বছরের উপর ফ্রান্সে বসবাস।এই দেশের ছেলে মেয়েদের ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। কমিউনিটির নতুন পুরাতন অনেক মানুষের সাথে তার হৃদ্যতা ও যোগাযোগ।বয়স্ক মানুষ, তার উপর একা থাকেন।এই সময়টা তার জন্য বেশী ঝুঁকির।সকল পরিচিতজন তাকে ফোন করে খবর রাখে। আমার সাথে মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় কথা হয়।ওনার কাছ থেকে কমিউনিটির কিছু খবর মেলে।খবরগুলো কানে কানে শোনা।

আপা জানালেন, সাতু দো ফনতেন ব্লু এলাকায় এক বাংলাদেশী যুবক মারা গেছে।লোকটি হার্ডের সমস্যা নিয়ে হসপিটালের ভর্তি হয়েছিলেন।পরে ডাক্তার তার স্ত্রীকে জানায়, তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।পরবর্তীতে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ লোকটির সাথে আর পরিবারের লোকদের দেখা করতে দেয় না।তিনদিন পর পর হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পরিবারকে জানায় লোকটি মারা গেছে।লোকটি বয়সে তরুণ, দুই সন্তানের জনক।শুনে খুব কষ্ট হচ্ছিলো প্রবাসী ভাইটির এমন পরিণতির জন্য।সেই সাথে স্বজনহীন এই ভিনদেশে তার তরুণী স্ত্রী ও দুইটি সন্তানের ভবিষ্যৎ সংগ্রামের কথা ভেবেও খুব হতাশ হচ্ছিলাম। 


প্রথম দিকে অনেকের মধ্যে সন্দেহ ছিল, করোনা আক্রান্ত মানুষদের কি হসপিটাল কর্তৃপক্ষ যত্নসহকারে চিকিৎসা করছে? মৃতদের লাশ কি করছে?পুড়িয়ে ফেলছে নাকি গণকবর দিচ্ছে।নানা গুজব কথাবার্তাও উড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীতে যখনই কোথাও কোন যুদ্ধ বিগ্রহ,দুর্যোগ বা মহামারী লাগে তখন সত্য খবরের পাশাপাশি নানাবিধ গুজব খবরও বাতাসের বেগে ঘুরে বেড়ায়।বিষয়টি চিরাচরিত। মানুষ দিশেহারা সময়গুলোতে খবরের সত্যতা যাচাইয়ের মানসিকতা হারিয়ে ফেলে ফলে অনেক গুজব খবর সত্যের মত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।করোনা ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম থেকে জেনে আসছি ভাইরাসটি মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয়, এবং এটি প্রানিবাহিত একটি ভাইরাস।কিন্তু গৃহবন্দি সময়ে নতুন করে জানলাম প্যারিসের শ্যেন নদীর পানিতে নাকি এই ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই নদীর পানি স্পর্শ করলে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।খবরটি কয়েকদিন ফোনে ফোনে একজনের  কান থেকে অন্যের কানে দৌড়ে বেড়াল। অনেকের ফেচবুক স্ট্যাটাসেও ভেসে বেড়াল।যার ফলে, চরম ভীতিকর সময়ে ফ্রান্সের মানুষের মধ্যে ভীতি আরও ঘনীভূত হল।       

 

টেলিভিশনে মাঝে করোনা ভাইরাসের সংক্রমে প্রাণ হারানো বিভিন্ন স্বজনদের উপর প্রামাণ্য চিত্র দেখায়।একদিন  মারী  নামের এক সত্তর ঊর্ধ্ব ফরাসি মহিলা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলছিল, আমাদের দাম্পত্য জীবন চল্লিশ বছরের।ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।সুখ দুঃখ, হাসি আনন্দে পারি দিয়েছি জীবনের এতোটা বছর।এই বয়সে আমরা একে অপরের উপর খুব নির্ভরশীল ছিলাম।হঠাৎ ছেবাসতিয়া’র ঠাণ্ডা কাশি শুরু হল, পরে প্রচণ্ড জ্বর।জরুরী নম্বরে ফোন করলাম।এম্বুলেন্স এসে ওকে নিয়ে গেলো।দুইদিন পর হসপিটাল থেকে জানানো হল,ছেবাসতিয়া করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত।ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি ওর সুস্থতার জন্য। প্রতীক্ষা ছিল সুস্থ হয়ে ছেবাসতিয়া ফিরে আসবে।কিন্তু পাঁচ দিন পর হসপিটালের নম্বর থেকে ভেসে আসে ওর মৃত্যুর সংবাদ।ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, এতো বছর যে মানুষটির সাথে একই ছাদের নিচে কাটল, সেই মানুষটিকে শেষ বেলায় আমি সেবা করতে পারিনি।জীবনের  কঠিন সময়ে ওর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ জুটল না।চলে যেতে হবে জানি, কিন্তু ওর এমন বিদায় মেনে নিতে পারিনা, মনে পড়লে কষ্টে বুক ভারী হয়ে ওঠে। 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

বুধবার, ২১ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫ )

কয়েক দিনের স্বেচ্ছা নির্বাসন ভেঙ্গে শরীরটাকে একটু চাঙা করার জন্য দৌড়াতে বাইরে বের হতে উদ্যত হলাম।ঘরের দরজা পার হতেই ভেতরে কেমন যেন এক অবিশ্বাস জেগে বসলো। মনে হল, বাইরের খোলা প্রকৃতি, বিল্ডিঙয়ের লিফট থেকে আরম্ভ করে বের হওয়ার দরজা, প্রতিটি জিনিস যেন বিশ্বস্ততা হারিয়েছে।কিছুদিন আগেও যে প্রবেশ দরজার হাতল, লিফটের বোতাম ধরতে কোন দ্বিধা ছিলোনা।এখন কেন যেন সবকিছুকেই ঘাতক মনে হয়।সন্দেহ হয়, কারো স্পর্শে লিফটের বোতামে,দরজার হাতলে লেগে আছে ভাইরাস।যতবার স্পর্শ করি ততবার হাতে স্যানিটারি জেল মেখে সন্দেহ দূর করতে হয়।  


অনেকদিন পর রাস্তায় নেমে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা বিশালতায় ভরে গেলো।ধীরে ধীরে দৌড়াচ্ছি আর চার পাশের পরিবেশ দেখে চেনা শহরকে অচেনা লাগছে।প্রায় জনমানবশূন্য রাস্তা। কয়েকটি এম্বুলেন্সের ছুটে গেলো সাইরেন বাজাতে বাজাতে। যে রাস্তা এক সময় দখলে ছিল বাস,প্রায়ভেট কারের এখন সেই রাস্তায়  এম্বুলেন্সের একার রাজত্ব।রাস্তার ধারের ডাস্টবিনগুলো ময়লা উপচিয়ে আছে মেরী দো পারি’র নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের বিরতির কারণে।কিছু বয়স্ক মানুষ মাস্ক পরে পোষা কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে,চলার পথে কেউ পাশাপাশি হলে উভয়েরই দূরে সরার চেষ্টা। সবার চোখে সন্দেহ, হয়তো পাশের পথ চলা মানুষটির শরীরে রয়েছে করোনা ভাইরাস। 


এভাবে পরপর দুদিন রাস্তায় বের হলাম দৌড়াতে।শরীরটা হালকা মনে হল, শ্বাসপ্রশ্বাস আগের থেকে আরও ভালো অনুভব হচ্ছে।ডাক্তার প্রতিদিন নিশ্বাস বন্ধ করে সংখ্যা গুনতে বলেছে সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য। আগে ত্রিশ পর্যন্ত গুনতে পারতাম,দুদিন দৌড়ানোর পর চল্লিশ পর্যন্ত গুনতে পারি।কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত রিপোর্ট আর টিভি সংবাদ হতাশা বাড়াতে লাগলো।হসপিটালে বেডে করোনা রুগীর চিকিৎসার পাশাপাশি কফিনও প্রস্তুত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এমন দৃশ্য দেখে পৃথিবীটাকে খুব নশ্বর মনে হতে লাগলো। মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা মনের উপর দারুণ প্রভাব ফেলত লাগলো। প্রতিদিন ছয় সাতশো মানুষের মৃত্যুর সংবাদ স্বাভাবিক চিন্তাধারার উপর এক কালো ছায়া ফেলো দিলো।মনে হল, জীবনটা এখন লটারি হয়ে গিয়েছে। এই করোনা ঝড় পরবর্তী পৃথিবীতে বেঁচে থাকা ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে।মনে হল, বেঁচেই থাকার আশা যদি এতো দোদুল্যমান হয়ে যায় তাহলে ভালোভাবে বেঁচে থাকার পরিকল্পনায় পরিশ্রম করে কি লাভ। মনের মধ্যে এমন শঙ্কা জেগে বসলো, মনে হল যে কদিন বাঁচি অবশিষ্ট শ্বাস প্রশ্বাসের স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকি । 


জুন থেকে  সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষার একটি কোর্সের উপর আমার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা।ভাষা কোর্স শেষ করার পর ফ্রেঞ্চ একাউন্টেন্সি উপর একটি পেশাদার কোর্স করার পরিকল্পনা রয়েছে।সে জন্য কোর্সটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসার বসে বেশ প্রস্তুতিও চলছিলো।এই কোর্সটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একটি স্বপ্নের বীজ।কোর্সটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারলে স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হবে। চলমান হতাশার দিনগুলোতে জীবনের সমস্ত স্বপ্নগুলো যেন ফিকে হয়ে আসতে লাগলো।জীবনের আশা মানুষের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে।যেখানে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে, সেখানে স্বপ্নগুলোও যেন ম্লান হতে থাকে।আমার ক্ষেত্রও এমন অনুভূতি দারুণ ভাবে চেপে বসলো।পড়াশুনা ছেড়ে দিলাম।মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী এসে বলে, এখন আর ফ্রেঞ্চ কোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছনা যে, আমি বলি জীবন থাকলে ফ্রেঞ্চ কোর্সের প্রয়োজন রয়েছে, জীবনের আশা যখন এতো ক্ষীণ তখন ফ্রেঞ্চ পড়ে কি হবে? বরং পারিবারিক সময়গুলো উপভোগ করি।


করোনার কারণে ভালো যে ব্যাপারটি ঘটলো তাহলো আমরা তিনজন এখন চব্বিশ ঘণ্টা এক সাথে কাটাচ্ছি।মেয়ে সাথে খেলছি।ওর অন্য কোন সঙ্গী না থাকায় আমার সাথেই ওর ঝগড়া ,আবার মিল হয়ে গেলে খেলাধুলা।প্রতিদিন ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে মিশেল সিনেমা হল বানায়,আমাকে এবং তার মাকে ডেকে নিয়ে তার বানানো সিনেমা হলের চেয়ারে বসায়, সিনেমার সঙ্গে খাবার ব্যবস্থা রাখে বাদাম ও মুড়ি।তার পর কম্পিউটারে ইউটিউব থেকে চালিয়ে দেয় তার পছন্দের কোন নাটক বা সিনেমা।কয়েক দিন চলল ওর সাথে আমাদের সিনেমা সিনেমা খেলা।

ওর সাথে যখন খেলাধুলা করি তখন আমার মধ্যেও শিশু ভাব জেগে ওঠে।


মিশেলকে আমি প্রথম দেখেছি ওর তিন বছর বয়সে প্যারিসের শার্ল দ্য গোল এয়ারপোর্টে। এর পূর্বের পুরো সময় কাটিয়েছে  তার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে। আমি যখন ফ্রান্সে চলে আসি তখন সে পৃথিবীতে অনাগত,মায়ের গর্ভে অবস্থান নিয়েছে মাত্র।স্বভাবতই, আমার চেয়ে তার মায়ের প্রতি টানটা একটু বেশী।এখানে আসার পর আমার পাশে শুয়ে কখন ঘুমায়নি, কিন্তু এই গৃহবন্দী সময় তার সাথে আমার সখ্যতা একটু বেশীই হয়ে গেলো।অনেক সময় তার মায়ের থেকে আমার সাথেই বেশী সময় কাটে।ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তাই আমার শাসন তার কাছে গুরুত্ব পায়না। আমিও শাসন করতে যাই না। উল্টো আমার বিরুদ্ধে সারাদিন অভিযোগ চলে তার মায়ের কাছে, বাবা আমাকে এটা করেছে, ওটা করেছে।তার মা ই একমাত্র শাসন বাঁধন দিয়ে তাকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখে।

এখন তার সকালে স্কুলের তাড়া নেই, রুটিন মাফিক ঘুমানোর সময় নেই। সব নিয়ম কানুন ভেঙে পড়েছে।তার মধ্যেও অনিয়মের মজা দারুণ ভাবে ভর করে বসেছে। অনিয়ম করার নতুন নতুন ফন্দি তার মাথায় খেলা করে, আর আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বলে।কারণ ফন্দিগুলো বাস্তবায়ন করতে আমার প্রয়োজন, তার মায়ের সাথে করা কখনোই সম্ভব নয়।একবার নতুন একটি ফন্দি আঁটল সে, তার মা রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লে আমি আর সে ড্রয়িং রুমে চলে আসবো,তার পর মোবাইলে গেম খেলবো,কার্টুন দেখবো আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে তার। 

তার পরিকল্পনা মত আমি রাজি হলাম। আমি ভাবলাম এমনিতেই বলছে রাত্রে ভুলে যাবে।কিন্তু সত্যিই মধ্যরাতে পিনপতন নীরবতায় আমাদের রুমে এসে আমার কানে ফিস ফিস করে বলছে, বাবা উঠো,বাবা উঠো।তার মা ঘুমিয়ে ঘোরে চলে গেছে, আমি আর সে পা টিপে টিপে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম।ফ্লোরে বিছানার আয়োজন করলাম।মিশেল জানালার কাছে গিয়ে পর্দা টেনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি দেখল। ভয় পাবে বলে আমি তাকে ঘুমোতে বললাম, কিন্তু সে বলল তুমি ঘুমাও বাবা, আমি রাত দেখি।আমি বেশী কিছু বললাম না। মনে হল, প্রকৃতিকে নতুন রূপে আবিষ্কারের কৌতূহল জেগেছে তার মধ্যে।নিজের মত করে এভাবে তার রাত দেখা হয়নি কখনো তাই নিস্তব্ধ রাতের প্রকৃতি তাকে বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করছে।ওর মধ্যে আমরা কখনো ভয় জাগায়নি, ভয়ের গল্পও করিনা কখনো, তাই ওর মধ্যে অবাস্তব ভূতের ভয় নেই।


ছোট বেলায় আমরা রাতকে ভয় পেতাম, কারণ ঐ সময় বড়রা ভূতের গল্প করত, রাতে ভূত পেত বের হয়, তারা মানুষ খায়,এমন অবাস্তব গল্প শুনে শুনেই আমরা বড় হয়েছি। এই ভয়ে সন্ধ্যে নামার পর থেকে ছেলে বেলায় একলা থাকতে ভয় লাগতো।রাতে আমি নিজের ছায়া দেখে ভয় পেতাম। আমার মনে হতো এই ছায়াটাই বুঝি ভূত। আমাদের বড়রা যদি আমাদের ছেলেবেলায় ভূতের গল্প না করে, রাতের সৌন্দর্য বর্ণনা করত তাহলে হয়তো রাতের ভীতি আমাদের মধ্যে তৈরি হতো না।রাতের আকাশে তারা ঝিকমিক করে, চাঁদ জোছনা ছড়ায়,ঝিঝি পোকা ডাকে, জোনাকিরা মৃদুমন্দ আলো ছড়িয়ে উড়ে বেড়ায়।ভূত পেতের পরিবর্তে মূলত রাতের এমন সৌন্দর্যের বর্ণনাগুলো যদি আমাদেরকে করা হতো তাহলে আমাদের ছেলেবেলায় রাতের ভীতি তৈরি হতোনা।ভীতি একটি শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নিজের সন্তানের মধ্যে তাই অবাস্তব ভূতের ভীতি তৈরি করিনি। তাই গভীর রাতের নিস্তব্ধতা আমার মেয়েকে ভয় না জাগিয়ে বরং মুগ্ধ করেছে। 


এই প্রথম অনিয়ম করে মিশেলের সাথে গভীর রাতের একটি সুন্দর আড্ডা হল,সেইসাথে পার হল বাপ মেয়ের প্রথম একত্রিত একটি স্মৃতিময় ঘুমের রাত।


করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)


মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪ )

আমার বাসার সামনে ছোট্ট একটি পার্ক।ঘরের ভেতর থেকে পার্কের সবুজ ঘাসে আবৃত ভূমি এবং প্রশস্ত আকাশ দেখা যায়।মাঝে মাঝে সাদা মেঘের পাহাড়ের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হই। ড্রয়িং রুমের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দুপুরের রোদ এসে উঁকি দেয় ঘরের মধ্যে। কিন্তু,মধ্য মার্চে শেষের দিকে বাইরে ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে। মুক্ত বাতাসের জন্য দিনে দুই একবার উষ্ণতাবর্ধক পোশাক পরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়।ঘরের মধ্যে ইলেকট্রিক হিটারের উষ্ণতায় গরম চায়ের কাপে চুমুক,টেলিভিশনের পর্দায় খবর, মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়েই কয়েকটা  দিন ভালোই কেটে গেলো।ধীরে ধীরে প্রাত্যহিক এমন জীবন ধারায় একটু অস্থির হয়ে উঠলো মন, শরীরটাও ভারী ভারী অনুভব হয়, গলা ব্যথা ও খুশখুশে কাশি লেগেই আছে।ডাক্তারের বারণ বাইরে না যাওয়ার। কিন্তু এমন আবদ্ধ জীবনে কেমন যেন মানসিক অসুস্থতা বোধ হতে লাগলো।মনে হলো অনেকটা শৃঙ্খলিত হাজত বাস চলছে জীবনে।জীবনের প্রকৃত হাজত বাসের অভিজ্ঞতা সাথে মিলে খুঁজে পাচ্ছিলাম চলমান আবদ্ধ জীবন ধারায়। 

২০০৩ সাল, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী পরিচালিত ক্লিন হার্ড অপারেশন চলছে।দেশ জুড়ে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের জন্য এক ভীতিকর পরিস্থিতি।সরকারী দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে কথিত ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছে।তখন আমার তারুণ্য দৃপ্ত ছুটে চলা জীবন।পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি,থিয়েটার,স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা,বিএনসিসি’র কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রাণোচ্ছল ব্যস্ততা।কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাশীল বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের প্রার্থীকে হারিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী প্যানেল থেকে বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি।কিন্তু আমাদের দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল। তখন প্রাক্তন ওয়ার্কাস পার্টির নেতা আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের বিএনপিতে যোগদানের কারণে ছাত্র মৈত্রীর অনেক স্থানীয় নেতা ছাত্রদলে যোগদান করেছে।প্রাক্তন বিএনপি এবং নব্য খৈয়ম অনুসারী বিএনপির নেতা কর্মীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিরাজমান।এর মধ্যে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজন হলো জেলা ছাত্রদলের সম্মেলন।ঢাকা থেকে আসলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল সম্মেলন সম্পন্ন করতে।কিন্তু সম্মেলনে তার ঘোষিত কমিটি পছন্দ হল না খৈয়মপন্থী ছাত্রদল নেতাদের।কেন্দ্রীয় সভাপতির সামনেই শিল্পকলা একাডেমীর অডিটোরিয়ামের চেয়ার ভেঙে বিদ্রোহ ঘোষণা করল খৈয়মপন্থী ছাত্র নেতারা।কেন্দ্রীয় সভাপতি এই ঘটনাকে চরম অপমানের সহিত নিলেন। জানালেন কেন্দ্রীয় ঊর্ধ্বতন নেত্রীবৃন্দের নিকট।উপর থেকে নির্দেশ আসলো রাজবাড়ী জেলা পুলিশের নিকট।সম্মেলনে বিশৃঙ্খলাকারী সবাইকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তারা  পুলিশ কাস্টরি দেখতে চান।শুরু হল শহর জুড়ে পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের ছোটাছুটি।একদিন চলে গেলো কিন্তু তালিকাভুক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারলো না পুলিশ।ফলে পুলিশের উপর ওপরের চাপ বাড়তে থাকল।আমার এলাকার বন্ধু সাবেক ছাত্রদল নেতা আহমেদ হোসেন সাগর(ছাত্র মৈত্রী থেকে আসা) এই অভিযুক্তদের তালিকায় শীর্ষের একজন।ওর বাড়িতে পুলিশ কয়েকবার হানা দিয়েছে কিন্তু ধরতে পারেনি।আমি সবকিছু জেনে স্বাভাবিক ভাবে ঘোরাঘুরি করছি।এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে চলার কোন উদ্বেগ আমার মধ্যে জাগেনি বিন্দু মাত্র।কারণ,আমি অন্য একটি রাজনৈতিক  ছাত্র সংগঠনের সদস্য। 


 রাজবাড়ী রেলওয়ে হলে থিয়েটারের মহড়া শেষ করে দুপুরে বাড়িতে এসেছি।গোসল সেরে বিকেলে উচ্চ মাধ্যমিকের এক ছাত্রীকে হিসাববিজ্ঞান পড়াতে যেতে হবে,সেই চিন্তায় মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি।হঠাৎ বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে করা নড়ে উঠলো। কেউ একজন বলছে উজ্জ্বল ভাই বাড়ীতে আছেন? আমার মা ডাক শুনে বাড়ীর গেট খুলে দিলেন। মধ্যবয়সের এক লোক বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন।আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটিকে চিনতে পারলাম।জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার লোক।আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে সিভিল পোষাকে মাঝে মাঝে ডিউটি করে। আমি ভদ্রলোককে ঘরে আসতে বললাম।ভদ্রলোক খুব শান্ত গলায় বললেন, ভাই আমাদের স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলবে, উনি রাস্তায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।আমি পোশাক পরিবর্তন করে যেতে চাইলাম। কারণ আমার পরনে বাসায় পরার লুঙি এবং গেঞ্জি।চেয়েছিলাম প্যান্ট পরে গেঞ্জিটা পরিবর্তন করে নিতে।কিন্তু ভদ্রলোক বলল এখনিতো চলে আসবেন,দরকার নেই। আমি সরল বিশ্বাসে ওনার সাথে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলাম। মাকে বললাম,আমি আসছি।আমার মধ্যে পুলিশ ভীতি নেই কারণ স্থানীয় সাংবাদিকতা করার কারণে থানা,পুলিশ,আইন আদালতে মাঝে মাঝে যাওয়া আসার অভিজ্ঞতা ছিল।বাড়ী থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ হাঁটার পর ভদ্রলোকের সঙ্গে আরও চারজন লোক যুক্ত হল।এদের মধ্য থেকে একজন খুব শক্ত করে আমার কোমরে হাত দিয়ে লুঙ্গি পেঁচিয়ে ধরলেন।আমি বললাম,আমিতো আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি লুঙি ছেড়ে দেন।উত্তরে বলল, এমনিতেই ধরে আছি, চলুন।বেশ কিছুটা পথ এগুনোর পর আমি পেছন ফিরে তাকালাম,দেখি আমার পেছন পেছন এলাকার অনেক মানুষ হেঁটে আসছে।এলাকায় দুদিন ধরে পুলিশের অভিযানের কারণে আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া দেখে মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।আমাকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে? আফছারের দোকান তিন রাস্তার মোড় আসার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আপনাদের স্যার?একজন বলল,আপনাকে কিছু সময়ের জন্য থানায় যেতে হবে, উনি থানায় আছেন, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করে ছেড়ে দেয়া হবে।আমার মধ্যে তখনও কোন আতংক কাজ করছেনা। বললাম, তাহলে চলুন।আমাকে একটা রিক্সায় ওঠানো হল।আমার সাথে রিক্সায় উঠলেন দুইজন গোয়েন্দা পুলিশ।একজন আমার কোমরে লুঙি পেঁচিয়ে ধরলেন, অন্যজন শক্ত করে ধরলেন হাত।আমি এদের আচরণে আশ্চর্য হচ্ছিলাম, এরা কেন আমার সাথে এমন আচরণ করছে! রিক্সায় থাকাকালীন সময়ে কারো সাথে তেমন কথা হলনা।বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলাম থানায়। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল থানার ওসি’র রুমে। ওসিকে ঘিরে বসে আছে চার পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তা।আমাকে বসানো হল মাঝের একটি চেয়ারে।যারা আমাকে ধরে নিয়ে আসলো তাদের মধ্য থেকে একজন  পুলিশ কর্মকর্তাদের বললেন, স্যার একে এরেস্ট করতে খুব কষ্ট হয়েছে, দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো,সবাই মিলে তাড়া করে ধরে নিয়ে এসেছি।এমন একটি মিথ্যা শুনে একটু হোঁচট খেলাম।মনে মনে বললাম, আমিও ওদের কথার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এসেছি, এমন একটি মিথ্যা কথা কেন বলল? কিছুক্ষণের মধ্যে শুধু হল একের পর এক প্রশ্নবান।প্রথমেই ছাত্রদলের সম্মেলনে বিশৃঙ্খলাকারী খৈয়মপন্থী কয়েকজন ছাত্রনেতাদের  নাম উল্লেখ করে প্রশ্ন করলেন, এরা সবাই কোথায় আছেন?যাদের নাম বললেন আমি তাদের সবাইকে চিনি,কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা কোথায় আছে আমি জানিনা।স্বাভাবিক কারণে আমি উত্তর দিয়েছি, আমি জানি না।আর একজন প্রশ্ন করলেন, এদের মধ্যে কে কে অস্ত্রবাজি করে? যেহেতু এদের কারো সাথে আমার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক বা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নেই, সুতরাং অস্ত্রবাজি কেউ করে থাকলে আমার জানার কথা নয়।তাই, উত্তরে বললাম আমি জানিনা।পুলিশ কর্মকর্তাদের একজন বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, উপুড় করে ঝুলিয়ে নাক দিয়ে গরম পানি ঢালুন ওসি সাহেব,সব বলে দেবে, এমনিতে কোন কিছু বলবেনা।এদের এমন আচরণ এবং প্রশ্নে আমি অনেকটা ঘাবড়ে গিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছিলাম। কারণ জীবনে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আমি পড়িনি কখনো।আমি কান্না অবস্থায় ওদেরকে বলছিলাম, আমিতো বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র রাজনীতির সাথে জড়িত, ছাত্রদলের সম্মেলনেতো আমি উপস্থিত ছিলাম না, এই ঘটনার সাথেও আমি সম্পৃক্ত নই। তাহলে এদের সম্পর্কে আমি জানবো কি করে?  ওদের একজন বললেন,যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সবাই ছাত্র মৈত্রী করত,ওরা সবাই তোর বন্ধু, তুই জানিস ওরা কোথায় আছে।যেহেতু, প্রকৃতই আমি কিছু জানিনা সেহেতু ওদের কাঙ্ক্ষিত উত্তরও আমার কাছ থেকে ওরা পাচ্ছিল না।জেরা করার একটা পর্যায়ে একজন পুলিশ কনস্টেবল আমার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দিলো।কিছুক্ষণ পর ওসির রুম থেকে আমাকে এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের রুমে নিয়ে এলো।  এখানে  হ্যান্ডকাফের দড়ি জানালার গ্রিলের সাথে বেধে একটি চেয়ারে বসতে দিলো।নিজেকে গরু ছাগল মনে হতে লাগলো।কারণ, গরু ছাগলকে গলায় দড়ি পরিয়ে এভাবে বেধে রাখা হয়। একটু পর বয়সে তরুণ এক সহকারী পুলিশ সুপার আমার কাছে আসলো, যিনি আমাকে প্রশ্ন করার সময় ওসির রুমে উপস্থিত ছিলেন।ভদ্রলোক হয়তো কয়েক বছর আগে ছাত্রজীবন শেষ করে চাকুরীতে প্রবেশ করেছে।ক্যাম্পাসের ছাত্র রাজনীতি ও সহিংসতা সম্পর্কে তার প্রকৃত ধারণা রয়েছে।আমি কি পড়ি, কি করি ইত্যাদি খুব আন্তরিকতার সহিত জিজ্ঞেস করল।আমি সব বর্ণনা করার পর, বলল ক্যাম্পাসে অস্ত্রবাজির রাজনীতি করার কি দরকার। ভালোমতো পড়াশুনা করলেই তো হয়, তাহলে এই জাতীয় ঝামেলায় পরতে হয় না।আমি বললাম,ছাত্র রাজনীতি করি ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য, কিন্তু অস্ত্রবাজিতো করিনা।ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে বলল, এটা সবাই বলে।বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর যাবার বেলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভয় পাবার কিছু নাই, তোমার বন্ধুদের ধরতে পারলেই তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে।তরুণ পুলিশ কর্মকর্তাটি হয়তো অনুধাবন করেছিলো এই ঘটনার সাথে আমি প্রকৃতই সম্পৃক্ত নয়। 


আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে এ ঘটনা ইতোমধ্যে শহরের রাজনীতি অঙ্গন ও পরিচিত স্বজনদের মধ্যে মুহূর্তেই প্রচার হয়ে গিয়েছে। প্রথমেই থানায় ছুটে আসলো পারভেজ ভাই।উনি প্রথমত ঐ সময়ে আমার নিজ রাজনৈতিক দলের বড় ভাই এবং আমার ক্লাসের বান্ধবী পলিনের বর।পারভেজ ভাই কর্তব্যরত এস আইকে বললেন, ও আমার মিসেসের ক্লাস মেট, খুব ভালো ছেলে, ওকে ধরে এনেছেন কেন? এস আই মহিলা বলল, এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবোনা, বিষয়টি এখন আইনি প্রক্রিয়ায় চলে গিয়েছে। আপনি ওসি স্যারের সাথে কথা বলুন।কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ কনস্টেবল এসআই’র অফিস কক্ষ থেকে আমাকে নিয়ে গিয়ে থানা হাজতে ঢুকিয়ে দিলেন।কাস্টরীর দরজায় ঝুলিয়ে দেয়া হল বড় একটা তালা।কথা ছিল, থানার কর্মকর্তার সাথে কথা বলার কিন্তু করা হল বন্দী। প্রতিটি ঘটনার একটি যোগসূত্র থাকে কিন্তু আমার এই বন্দীদশার সাথে কি যোগসূত্র রয়েছে? ভেবে পাচ্ছিলাম না।ঐ মুহূর্তে জীবন,ভাগ্য,দুর্ঘটনা, সমাজ,রাষ্ট্র ,রাজনীতি সম্পর্কে  আমার মধ্যে নতুন এক ধারণা তৈরি হল।মনে হল, আমরা যে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি,এই সমাজে আমি অপরাধ না করলেও অপরাধী প্রমাণিত হতে পারি। আবার অপরাধ করেও সমাজে সাধুর স্বীকৃতি মিলতে পারে।পৃথিবীতে নিয়মের সূত্রের বাইরেও অনেক অনিয়ম হয়। এই যে হাজতের ছোট্ট ঘর, এই ঘরের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করা মানুষদের প্রতি দৃষ্টির পার্থক্য বিস্তর। যারা ভেতরে থাকে, বাইরে থেকে তাদেরকে দেখা হয় অপরাধী হিসেবে।বিবেচনা করা হয়না, ভেতরের মানুষটি আসলেই অপরাধী কিনা। বন্দী হলেই বাইরের মুক্ত মানুষগুলোর আচরণ হয় অসৌজন্য এবং অসম্মানজনক।কেউ বাইরে যত বড় সম্মানিত,প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোকনা কেন, একবার এই ঘরের ভেতরে ঢুকলেই অন্যেরদের তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়।এমন পরিস্থিতিটিতে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম,অনেকক্ষণ চোখের জল ঝরিয়ে গলা ছেড়ে কেঁদেছিলাম।কয়েকদিন ধরে এই হাজতে বন্দী দশা চলছে মধ্যবয়সী আর একজন মানুষের। এমন কান্না দেখে মানুষটি আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। সব ঘটনা শুনে বলল, তোমার তেমন কিছু হবেনা ভাতিজা। প্রথম বারের মত এমন পরিস্থিতিতে পরেছ, তাই তোমার ভয় লাগছে।ভদ্রলোক শিক্ষিত,নাম মান্নান এবং রাজবাড়ীর সোনালী ব্যাংকের একটি শাখার কর্মকর্তা ।তার বড় ভাই একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।রাজনৈতিক ও পারিবারিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী।জেলা সার্কিট হাউজের সেনা ক্যাম্পের অভিযোগ বাক্সে পড়েছে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজির অভিযোগ।সেনা সদস্যরা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গ্রেপ্তার করে হাজতে পুরে রেখেছে কয়েক দিন ধরে।ভদ্রলোকের কথাবার্তায় সাহসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী।আমাকে বলেছিল, কান্না করে কি হবে ভাতিজা, তোমার কান্না শুনে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে দেবে না। তুমি ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছ।তোমাকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তার কথায় আমি কান্না থামিয়ে স্বাভাবিক হয়েছিলাম।ভেতরে সাহস সঞ্চার হয়েছিলো।এর মধ্যে আমার বাবা থানায় এসে দেখল আমি থানা হাজতে বন্দী অবস্থায়।সে থানার মধ্যেই চিৎকার শুরু করল, কেন আমার ছেলেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে? এক পুলিশ অফিসার বলল, অপরাধ করেছে তাই বন্দী রাখা হয়েছে।বাবা বলল, এমন ছেলে জন্ম দেইনি,যে হাজতে বন্দী থাকার মত অপরাধ করবে। অফিসার বলল, প্রত্যেক বাবার কাছে তার ছেলে নিরাপরাধ, কিন্তু বাইরে ছেলেরা কি করে বেড়ায়, সে খবর কি রাখেন? এর মধ্যে আমাদের এলাকার অনেক পরিচিত লোক এসে থানায় ভীর জমিয়ে ফেলেছে।এলাকার মানুষের বিশ্বাস ছিলোনা আমি কোন কারণে পুলিশের দ্বারা গ্রেপ্তার হতে পারি।সেই কৌতূহল ও ভালোবাসার টানে ছুটে এসেছে তারা।ছোট বেলা থেকে তারা দেখেছে আমার সোজা সরল জীবন যাপন ও চলাফেরা।ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা নেতৃবৃন্দের মধ্যে থানায় ছুটে আসলেন রাজবাড়ী সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি রেজাউল করিম রেজা ভাই,জেলা যুব মৈত্রীর নেতা অ্যাডভোকেট শফিক ভাই,জেলা ওয়ার্কস পার্টির নেতা আরবান কমিশনার। সবাই থানার ওসির সাথে কথা বললেন, আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য।থানার ওসি তাদের বললেন কেসটি এখন জটিল পর্যায় রয়েছে, আমরা চাইলেই ছেড়ে দিতে পারবো না। শফিক ভাই বলেছিল, জটিল হলে ওকে কোর্টে চালান করে দিন আমরা জামিনে বের করে নেব।সবাই আমাকে কোন চিন্তা করতে নিষেধ করলেন,বললেন আমরা আছি তোর পাশে,ভয় পাওয়ার কারণ নেই।এর মধ্যে একই কারণে ফরহাদ নামের এক বিদ্রোহী ছাত্রদল কর্মীকে পুলিশ ধরে এনে হাজতে ঢোকালেন। হাজতের ছোট্ট ঘরের মধ্যে আমাদের সংখ্যা দুই থেকে তিনে উন্নীত হলো।তিনজন একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে অনেকটা হতাশা কাটিয়ে উঠেছি।ফরহাদের প্রতি আমার রাগ হওয়ার কথা ছিল, কারণ তাদের অপকর্মের ফল আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। কিন্তু ঐ সময় তার প্রতি আমার বিন্দু পরিমাণ ক্রোধ কাজ করেনি, বরং সহানুভূতি অনুভব হয়েছিল।মনে হয়,এই ছোট্ট ঘরে যারাই ঢোকে তারা সবাই আপনজন হয়ে যায়। কারণ আইনের গ্যাঁড়াকলে মাস্তান, প্রভাবশালী সবাই এই ঘরের মধ্যে অসহায়।সন্ধ্যা নেমে আসছে, রমযান মাস, চলছে থানার কর্মরত পুলিশদের ইফতারের প্রস্তুতি। আমাদের হাজত ঘরের সামনে দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইফতার সামগ্রী।ভেবেছিলাম আমাদেরকেও ইফতার দেয়া হবে।ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও মানবিক দিক চিন্তা করে।আমাদের তিনজনের মধ্যে দুইজন রোজাদার। দুজনেরই ইফতারের সময় পার হয়ে গেলো মুখে কোন খাবার না দিয়ে।কোন পুলিশ সদস্য জিজ্ঞেসও করলনা আমাদের মধ্যে কেউ রোজাদার কিনা।একটু হতাশ হলাম, এদের এমন আচরণে।হাজত ঘরে ঢুকলেই কি মানুষ অপরাধী হয়ে যায়? অপরাধী হলেও কি তার মানবিক আচরণ পাওয়ার অধিকার নেই?   


সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ পর বাবা ইফতার, কিছু পরনের কাপড় ও একটি পাঠ্য বই নিয়ে আসলেন।তিন হাজতবাসী ভাগ করে ইফতার করলাম।দিন কয়েক পরে পরীক্ষা তাই বন্দিত্বের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে বাবাকে বই আনতে বলেছিলাম।হাজত ঘরটি বেশ স্যাঁতসেঁতে, এই ঘরের এক কোণে সামান্য উঁচু দেয়ালের টয়লেট,টয়লেটটি তৈরির পর কখনো আর পরিষ্কার করা হয়েছিলো কিনা সন্দেহ রয়েছে।ভেতরের স্তর পড়া শ্যাওলা দেখে তাই মনে হলো।টয়লেটের ওয়াল এতো নিচু যে, কাস্টরির মধ্যে বসে টয়লেটের ভেতরের মানুষটির সবকিছু দেখা যায়।প্রসাব ছেপে রেখে কষ্ট করেছি কিন্তু টয়লেটে ঢোকার সাহস হয়নি।মনে হল, হাজতের মধ্যে নিচু ওয়ালের টয়লেট বানানো হয়েছে হয়তো দুর্ঘটনা এড়াতে বন্দীকে চোখে চোখে রাখার জন্য। টয়লেটের এমন বেহাল দশার কারণে লাভ হয়েছে  হাজতের পাহারারত পুলিশের।কোন বন্দী পাহারারত পুলিশের হাতে পাঁচ টাকা ধরিয়ে দিলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায় থানার স্টাফদের টয়লেটে।এমন পরিস্থিতিতে দারুণ একটা উপলব্ধি হল নিজের মধ্যে, সরকারের নির্ধারিত বেতনের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই বাড়ী, গাড়ি,বিলাসী জীবন যাপন করে থাকে।কিন্তু, এমন শান শওকত জীবন যাপন তো নির্ধারিত বেতনের পয়সায় হয়না।পুলিশের এই অতিরিক্ত  টাকা  আসে যাদের আমরা আসামী বলে থাকি তাদের পকেট থেকে।সেই কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকেও তো থানা হাজতের ছোট্ট ঘরটি ন্যূনতম মানুষের বাসযোগ্য করে রাখতে পারে।একটি গরুর গোয়াল ঘরও প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়।শোয়ার জন্য নিচে নাড়া পেতে দেয়া হয়। মানুষ আসামী হলেই কি গরুর ছাগলের চেয়োও নিচু প্রাণী হয়ে যায়? 

 

হাজতের মধ্যে একটি ছোট মাদুর পাতা,যেখানে একজন মানুষ বসতে পারে।যখন দুজন ছিলাম, তখন দুজনে  চেপে বসে মাদুরের উপর সময় কাটাচ্ছিলাম ।কিন্তু তিনজন হওয়ার পর আমাদের মধ্যে একজনকে বাধ্য হয়েই ঠাণ্ডা ফ্লোরে বসে থাকতে হল।সঙ্গে রক্তচোষা বড় বড় মশার দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে তিন জনের শরীরের উপর ।আত্মরক্ষার্থে মশা প্রতিহত করতেই তিনজন ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।রাত দশটার দিকে দলবেঁধে  ছাত্রদলের নবনির্বাচিত জেলা কমিটির নেত্রীবৃন্দ আসলো থানায়।আমাদের কাস্টডির সামনে সবাই এসে হাজির হল।ছাত্রদলের ফরহাদের সঙ্গে এই সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলল খুব ভালো ভাবে।আমি নবনির্বাচিত সভাপতি মিজানুর রহমান টিটুকে বললাম, ভাই এই ঘটনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই , এছাড়া আমি ছাত্র মৈত্রী করি, ওসিকে বলুন আমাকে ছেড়ে দিতে। উত্তরে তিনি বললেন, ঐ বালের সংগঠন করো কেন? করো বলেইতো ধরে নিয়ে এসেছে। ওনার এমন প্রতিউত্তরে আমি আর কথা বাড়াইনি।ছাত্র মৈত্রী’র প্রতি তার একটি ক্ষোভ বা প্রতিহিংসা ছিল।কারণ, কোন এক সময় কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্রদলের মধ্যকার এক সহিংস ঘটনায় ছাত্র মৈত্রীর ছেলেদের দ্বারা সে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন।যাইহোক,আমি যখন ঢাকাতে পড়াশুনা করি তখন মিজানুর রহমান টিটু জেলা ছাত্রদলের সভাপতি থাকা অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে গ্রিনরোডের সমরিতা হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।অনেকই বলে থাকে, তিনি যখন কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ছেলেদের দ্বারা আহত হয়েছিলেন তখন হসপিটালে ভুলবশত এক ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত তার শরীরে ঢোকানো হয়েছিলো।সেখান থেকেই নাকি তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেধেছে।সে সময় অনেক চিকিৎসা ও চেষ্টায় তার জীবন রক্ষা পায়নি। 


রাত বারোটা পর্যন্ত চলল থানার ভেতরে বাইরের মানুষের আনাগোনা।এরপর থানার মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হল।থানা জুড়ে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।পাহারারত কয়েকজন জন পুলিশ হাঁটাহাঁটি করছে, আর আমাদের তিন হাজতবন্দীর মধ্যে মৃদু স্বরে একে অপরের সুখ দুঃখের আলাপ চলছে ।রাত প্রায় একটা বাজে, এমন সময় থানায় প্রবেশ করল ক্লিন হার্ড অপারেশন ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের একটি টিম।আমার মধ্যে এক অজানা ভয় চেপে বসলো।বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা সংগঠিত অনেক রহস্যজনক ঘটনা ঘটার কথা ভেবে। একবার ওসির রুমে পুলিশের একটি টিমের অবান্তর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।এবার যদি সেনা সদস্যরা এই গভীর রাতে ডেকে নিয়ে একই প্রশ্ন করে।অর্থাৎ,জেলায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কারা করে? কার কার কাছে অস্ত্র আছে? তাহলে কি বলবো। এই চিন্তায় ভয়ে হৃদকম্পন বেড়ে গেলো।শরীরে ঘাম অনুভব করছি।দিনের বেলায় সর্বক্ষণ পরিচিত মুখগুলোর আনাগোনা ছিল থানায়। সেকারণে তেমন ভীতি কাজ করেনি।কিন্তু, এখন টর্চার করলেও কেউ দেখার নেই।কিছুক্ষণ পর আমাদের মধ্য থেকে ব্যাংকার ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া হল ওসির রুমে, সেখানে সেনা সদস্যদের টিম বসে আছে।আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবছি, ওনার পরে হয়তো আমার পালা।প্রায় এক ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদের পর ওনাকে আবার কাস্টডিতে ঢোকানো হল।জিজ্ঞেস করলাম কি হল,বললেন কেস সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ।প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলো কিন্তু আমার আর ডাক পড়লো না।এর কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যের টিমটি থানা থেকে বেরিয়ে গেলো। মনে হল বুকের উপর থেকে যেন একটি পাথর নেমে গেলো।সারা দিন মানসিক শারীরিক ধকল গিয়েছে, শরীরটাকে এবার মেঝেতে এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হল।ছোট্ট মাদুরটুকু বাকী দুজনের দখলে, আমার জন্য পড়ে আছে ফাঁকা ফ্লোর।বাবা একটি পত্রিকা দিয়ে গিয়েছিলো,বুদ্ধি করে ফ্লোরে পত্রিকাটি বিছিয়ে তার উপর পরনের কাপড় পেতে শুয়ে পড়লাম,বালিশের বিকল্প হিসেবে মাথার নিচে দিলাম মোটা একটি বই।কিন্তু মশার কামড়ে দু চোখ বন্ধ করার সুযোগ হল না। প্রায় নির্ঘুম একটি অভিশপ্ত রাত পার হল জীবন থেকে।   


হিম শীতল সকালে শরীরে কালো চাদর জড়িয়ে থানায় আসলেন সাপ্তাহিক তদন্ত প্রতিবেদন পত্রিকার সম্পাদক শহীদুল ইসলাম হিরন ভাই।বয়সে আমার অনেক বড় হলেও ঐ সময়ে হিরন ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সমবয়সী বন্ধুর মত।প্রতিদিনের একটা সময় কাটে তার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।সকাল বেলা হাজতের বন্দী খাঁচার ভেতর থেকে ওনার চেহারা দেখে মনটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠলো।বিপদের সময় আপন মানুষের চেহারা দেখলেও মনে বল পাওয়া যায়।সংবাদের প্রয়োজনে সাংবাদিকদের থানা পুলিশের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক থাকে।মনে হল,  হিরন ভাই আমাকে মুক্ত করার ব্যাপারে চেষ্টা করবেন।বেশ কিছুক্ষণ ওনার সঙ্গে কথা হল হাজতের লোহার শিকে ঘেরা দেয়ালের এপার ওপার থেকে।উনি বললেন,চিন্তা করোনা দেখি তোমাকে মুক্ত করার জন্য কি করা যায়,ওসি সাহেব থানায় আসলে আমি কথা বলবো।


থানার বেশ কিছু পুলিশ আমাকে চেনে,প্রতি বছর যখন বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে রাজবাড়ী জেলা স্টেডিয়ামে কুজকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় তখন আমি রাজবাড়ী সরকারী কলেজের বিএনসিসি প্লাটুনের নেতৃত্বে সামনে থাকি। আমাদের প্লাটুনের সামনে থাকে রাজবাড়ী থানা পুলিশ। সেই সুবাদে অনেকের চেহারা চেনা। এমন দুই তিনজন পুলিশ থানায় ডিউটিরত অবস্থায় আমাকে হাজতের খাঁচায় বন্দী দেখে এগিয়ে এসে কথা বলল, কেন আমি এখানে? জানতে চাইল।তাদের সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কিছু করার নেই।সেই সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে আবার ডিউটি শুরু করল।পুলিশ মানেই খারাপ নয়, অনেক মানবিক পুলিশ সদস্যও রয়েছে।তারা জানে এই খাঁচার মধ্যে শুধু অপরাধীরা থাকে না, অনেক সময় ষড়যন্ত্রের স্বীকার অনেক নিরাপরাধ মানুষের স্থান হয় এই অভিশপ্ত জায়গায়।অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ভালো মন্দ বিচার না করে গ্রেপ্তার করে আনতে এমন মানুষদের।এমনি এক মানবিক সিনিয়র পুলিশ কনস্টেবল আমার কাছে এসে অনেকক্ষণ গল্প করলেন।বললেন আপনি অন্যায় করেননি, কিছুটা হয়রানি হতে হবে কিন্তু কোন ক্ষতি আপনার হবে না, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।আমার পুলিশের চাকুরী জীবনে চক্রান্তের স্বীকার হয়ে আপনার মত এমন হাজত বাস কাটাতে হয়েছে।কিন্তু, আমারই জয় হয়েছে, কারণ আমি অন্যায়ের সাথে ছিলাম না। 

আমি ভেতরে কিন্তু আমাকে মুক্তির জন্য বাইরে ছুটাছুটি অনেক প্রিয় মানুষ।কলেজের অধ্যক্ষ ফোন করেছে পুলিশ সুপারকে আমার রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল রেখে, তিনি বলেছেন আমার কলেজের বিএনসিসি প্লাটুনের কমান্ডারকে আপনাদের থানায় বন্দী দেখেছেন, ওকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুণ তা নাহলে এবারের জাতীয় দিবসের কুজকাওয়াজে আমার কলেজের বিএনসিসি প্লাটুন অংশ গ্রহণ করবে না। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দও বিএনপি’র নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করে এই সমস্যার একটি সমাধানের পথ খুঁজছে। বাবা থানায় এসে জানালেন চেষ্টা চলছে ছেড়ে দিতে পারে। এর মধ্যে ছাত্রদলের ফরহাদ ও ব্যাংকার ভদ্রলোকে সকালে হাজত থেকে  নিয়ে যাওয়া হল অন্যত্র। আমি এখন এই ছোট্ট বন্দী শালায় একা। মাঝে মাঝে নিজের ভেতর অস্থির লাগছে, সারাদিন সবাই আশ্বস্ত করছে ছেড়ে দেয়া হবে,কিন্তু তালবদ্ধ দুয়ার খুলছে না কোন এক অদৃশ্য সংকেতের কারণে।জীবনের এতোটা দিন ইচ্ছে মত মুক্ত আলোবাতাসে ঘুরে বেড়িয়েছি, বাধা ছিলোনা কোন। আজ আমি চাইলেই কোথাও যেতে পারবোনা।অন্যের ইচ্ছের উপর নির্ভর করছে আমার মুক্ত আলো বাতাসে বিচরণ করা। ভেতরটা ছটফট করছে, কখন মুক্ত বিহঙ্গের মত খোলা আকাশে ডানা মেলে ভেসে বেড়াবো এই ভাবনায়।বিকেল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন আশার আলো দেখছিনা,কেউ একজন বলল আজ হয়তো ছাড়া হবেনা, কোর্টে চালান করা হতে পারে।শুরু হল খাঁচায় বন্দী ডানা ঝাপটানো পাখীর মত ব্যকুলতা।বন্দিত্ব যে কি কষ্টের তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি ঐ মুহূর্তগুলোতে। দিনের শেষের দিকে ছাত্রদলের অভিযুক্ত বিদ্রোহী ছাত্র নেতারা জেলা বিএনপি’র নেত্রীবৃন্দের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করল আর আমার হাজতের বন্ধ দরজা সহজে খুলে গেলো।বাবা আমাকে থানার ওসির রুমে নিয়ে বন্ডে সই করলেন, ওসি বাবাকে বললেন , আপনার দায়িত্বে ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু আমরা যে কোন প্রয়োজনে ডাকলে তাকে থানায় নিয়ে আসতে হবে। বাবা সব শর্ত পূরণ করে আমাকে বাড়ীতে নিয়ে আসলেন, এলাকার মানুষ ভিড় জমিয়ে ফেললেন আমার ছাড়া পাওয়ার খবর শুনে।মা নিম পাতার গরম পানি তৈরি করলেন গোছলের জন্য।

পরদিন বাইরে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে।প্রায় এক সপ্তাহ কাটল মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, কেন ধরে নিয়ে গিয়েছিলো পুলিশ? কি ঘটেছে বন্দি অবস্থায়?  


কোন কোন বিপদ মানুষকে অনেক কিছু শেখায়।আপন পর চেনায়। এই বিপদের মধ্য দিয়ে আমার প্রতি মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেরে আপ্লূত হয়েছিলাম। সমাজে অন্যের ক্ষতি না করে সোজা সরল জীবন যাপন করলে মানুষের অন্তরের ভালোবাসা পাওয়া যায়।তারই প্রমাণ পেয়েছি। পরবর্তী জীবনে এই অভিজ্ঞতা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, জীবন,সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।একটা প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, কোনদিন খাঁচায় বন্দি রেখে কোন পাখী পুষব না।কারণ, খাঁচায় বন্দি পাখীর কষ্টটা কেমন হয়ে থাকে তা বুঝেছিলাম ঐ চব্বিশ ঘণ্টার বন্দি জীবন থেকে।                  

 

চলমান করোনা কালে আমরা কয়েক দিনের গৃহবন্দী জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।অথচ, আমাদের অনেকেই বনের বিহঙ্গকে খাঁচায় বন্দী করে বাসার এককোণে ঝুলিয়ে রেখে আভিজাত্য দেখায়।যে পাখি উন্মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়, সেই পাখিটিকে ছোট্ট একটি খাঁচায় বন্দী করে মাসের পর মাস ওর কষ্টের জীবন থেকে বন্য আনন্দ লাভের চেষ্টা করি।একবারও কি বোঝার চেষ্টা করি, পাখিটির অতৃপ্ত, অশান্ত মনে খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাপটিয়ে বেড়ানোর কষ্ট।

বনের পাখিকে আদর দিলে খাঁচায় ঢুকিয়ে পোষার প্রয়োজন হয়না, এমনিতেই আমাদের কাছে আসতে পারে। আমার বাসার বারান্দায় প্রতিদিন বিষ পঁচিশটি কবুতর, কাক,দোয়েল খাবার সন্ধান করে।বাসার উচ্ছিষ্ট খাবার ডাস্টবিনে না ফেলে বারান্দায় রাখা নির্দিষ্ট একটি পাত্রে রেখে দেই।ওরা মনের আনন্দে সেগুলো খেয়ে নেয়।আমি কখনো বারান্দায় বের হলে কবুতরগুলো দূর থেকে ছুটে আসে আমার কাছে,নির্ভয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে পিছু পিছু।

ওরা ভাবে,আমি নই ওদের ভয়ের কোন জন,

আমি ওদের আপন

হয়তো এনেছে খাবার

হবে এবার ক্ষুধা নিবারণ ..। 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

শনিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২১

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৩)

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও  টেলিভিশনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ,করণীয়, সতর্কতা ইত্যাদি সংক্রান্ত ভিডিও দেখে ও আর্টিকেল পড়ে কোভিড ১৯ সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে জানা বোঝা ইতোমধ্যে বেশ পোক্ত হয়েছে।  

মার্চের মাসে  প্যারিসের তাপমাত্রা সকালে পাঁচ ছয় ডিগ্রী দিয়ে শুরু হলেও দিন শেষে প্রায় পনেরো ষোলোতে গিয়ে ওঠে।সারা দিনের  আবহাওয়ার তাপমাত্রার ওঠা নামার যে খেলা চলে তার প্রভাব মানুষের শরীরে গিয়ে পড়ে ।জ্বর সর্দী, গলা ব্যথা,কাশি এ সময়ের সাধারণ অসুখ।বেশ কদিন ধরে গলায় ব্যথা অনুভব করছি,মাঝে শুষ্ক কাশি, কখনো নিশ্বাস নিতে গেলে বুকের ডান পাশে অস্বস্তি অনুভব করি।বারবার চা পান করি।ঠাণ্ডা জল বাদ দিয়ে এখন নিয়মিত গরম পানি পান করছি,তবুও কাশি,গলা ব্যথা দূর হচ্ছে না।ভেতরে অজানা আতংক মাঝে মাঝে দারুণ ভাবে ভর করে।বাধ্য হয়েই ইন্টারনেটে আমার ব্যক্তিগত ডাক্তারের একটি সাক্ষাকার সময় নিলাম।এর মধ্যে সাধারণ জ্বর ঠাণ্ডা জনিত অসুখের রোগীদের ডাক্তাররা সশরীরে দেখা বন্ধ করে দিয়েছে।ডক্টর চেম্বারের অভ্যর্থনা থেকে কেউ একজন ডাক্তারের পূর্বে ফোন করে জানতে চায় কি সমস্যার জন্য সাক্ষাতকার চাচ্ছি।সমস্যা শুনে অভ্যর্থনা থেকেই বলে দেয় সরাসরি ডাক্তারের কাছে যেতে পারব কিনা। যাইহোক, আমার সমস্যা বলার পর ডক্টর চেম্বারে যাওয়ার অনুমতি মিলল না, বললেন ডাক্তার আপনাকে ফোন করবেন।১৯ মার্চ বেলা এগারোটার সময় আমার ডাক্তারের ফোন এলো।জানতে চাইলও আমার শারীরিক সমস্যার কথা।সবকিছু বর্ণনার পর কোন প্রেসক্রিপশন না দিয়ে বলল,ফ্রান্সে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিদ্যমান,সুতরাং আপনার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,যেহেতু আপনার শরীরে সবগুলো উপসর্গ এখনো প্রকাশ পায়নি তাই ১৪ দিন বাজার করা ও জরুরী কোন কাজে বাইরে না যাওয়া, পরিবারের অন্য সদ্যসদ্যের থেকে আলাদা থাকা ইত্যাদি পরামর্শ দিলেন এবং কোন সমস্যা অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন।এও বললেন, আপনার মেয়ে ভাইরাস বহন করে নিয়ে আসতে পারে, কারণ বিভিন্ন পরিবারের অনেক বাচ্চা একসঙ্গে সারাদিন স্কুলে অবস্থান করে।      

তাৎক্ষণিক ডাক্তারের কথা শুনে একটু হোঁচট খেলাম।ডাক্তার বর্তমান প্রেক্ষাপটের বাস্তবতা অনুধাবন করে আমার দেহে করোনার সংক্রমণ সন্দেহ করছে, কিন্তু দেহটাতো আমার নিজের,ভেতর থেকে বলছে আমি করোনা ভাইরাসে এখনো সংক্রমিত নই।আমার স্ত্রী বেশ সাহস যোগাল।বলল, ভয়ের কারণ নেই,এখনো সবগুলো উপসর্গ তোমার শরীরে নেই, অপেক্ষা করো।  

আমিও ভাবলাম, যাই হোক মনোবল শক্ত রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবো।মরার আগে মরে গেলে চলবে না। পৃথিবীটা আসলেই নিরাপদ জায়গা নয়। আজ এখানে করোনা আঘাত হেনেছে,তাই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মরছে আবার সুস্থও হচ্ছে।কিন্তু সারা পৃথিবীতেইতো প্রতিদিন নানা দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে।যে মানুষগুলো হয়তো সকালের সূর্য ওঠার পর জানেনা আজই তার জীবনের শেষ সূর্য উদিত হয়েছে, আর কোন দিনই চোখের দৃষ্টিতে  ধরা দেবে না এই ধরণীর আলো,সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য।তবুও মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠে বেঁচে থাকার আশায়।কিন্তু মানুষের বানানো মৃত্যুর ফাঁদে পড়ে অকালে প্রাণ দিতে হয় কত মানুষকে।    


 পৃথিবীতে কয়েক বছর পর পর কোননা কোন নতুন ভাইরাসের আক্রমণে অসংখ্য মানুষ মৃত্যু বরণ করে।কোন এক সময় প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়।ভাইরাসের ভয়ংকর আক্রমণ কোন এক সময় মানুষ প্রতিহত করতেও সক্ষম হয়।কিন্তু, প্রথম দিকে ভাইরাসের অতর্কিত হামলায় অপ্রস্তুত থাকায় অসংখ্য মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়।ভাইরাসের কথা বাদ দিলাম।যখন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ট্রেন, বাস, বিমানে উঠি, যতক্ষণ পর্যন্ত না গন্তব্যে পৌঁছাই ততক্ষণই মৃত্যু আমাদের পাশাপাশি বসেই অবস্থান করে। কারণ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে যে কোন মুহূর্তে মৃত্যু আঘাত হানতে পারে।আমাদের সারা জীবনের পড়াশুনা ,সুন্দর জীবিকা, পরিপাটি বাড়িঘরে বসবাস,ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কত কিছু নিয়েই না আমরা জীবন যাপন করে থাকি,  অথচ যে কোনো সময় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের ভয়ংকর থাবায় আমাদের  সাজানো গোছানো জীবন মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যা আমাদের চলমান বিশ্বের প্রাত্যহিক ঘটনা।কত শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর পৃথিবীতে কয়েক বছর অবস্থান করে পূর্ণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ ছাড়াই বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।ভাইরাসের কারণে মৃত্যু ভয়, অথচ আমরাই প্রতিদিন অধিক মুনাফার আশায় খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে ভেজাল মিশিয়ে একে অপরের জন্য প্রতিদিন মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করে রাখছি।পৃথিবীটা মানুষের জন্য অথচ এই পৃথিবীটাকে অনিরাপদ করার জন্য মানুষই প্রধানত দায়ী। প্রতিদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এক ধর্মের মানুষ খুন করছে অন্য ধর্মের মানুষকে,এক রাষ্ট্র হামলা চালাচ্ছে অন্য রাষ্ট্রের উপর,বর্ণবাদী সহিংসতায় এক বর্ণের মানুষ খুন করছে অন্য বর্ণের মানুষকে।কিন্তু, করোনা ভাইরাসের বিশেষ প্রীতি নেই বিশেষ কোন ধর্ম,বর্ণ বা রাষ্ট্রের প্রতি।অদৃশ্য করোনা ভাইরাস যুদ্ধ ঘোষণা করছে পৃথিবীর দৃশ্যমান মানুষের সঙ্গে।সুতরাং পৃথিবীর ঐ সব দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা ভাবার কোন কারণ নেই।একটি উন্নত দেশের বাসিন্দা হলেও একটি অনিরাপদ পৃথিবীর মানুষও আমি।উন্নত দেশের চিকিৎসা, অর্থ,বিত্ত,সর্বাত্মক চেষ্টা, সব কিছুকে পরাস্ত করে প্রতিদিন করোনা ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ।জীবনকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার কাছে সবকিছুর মূল্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে আজ।জীবন যদি না থাকে তাহলে কি মূল্য রয়েছে প্রাণহীন জড় প্রাচুর্যের।প্রাণই যে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ তা বর্তমান সময়ের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।তবে করোনা ভাইরাসের আগমন এমন সময়ে, যখন বিশ্বের  অর্থ অস্ত্রে শক্তিশালী দেশগুলো নিজ দেশের মানুষের জৌলুশপূর্ণ জীবন যাপন নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়ে অন্য দেশের মানুষকে বাস্তুহারা করে দিচ্ছে।ঠিক সেই মুহূর্তে করোনা তার তাণ্ডবের  মাঝে  পৃথিবীর সমগ্র  ধর্ম, গোত্র,বর্ণ ও রাষ্ট্রের মানুষকে একত্রিত করে একটি বার্তা দিয়ে যাচ্ছে, তাহলো, পৃথিবীতে শুধু একা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম নয়, সংগ্রাম হবে  পৃথিবীর সমগ্র মানুষের সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার সম্মিলিত সংগ্রাম।মানুষ বাঁচলেই ধর্ম থাকবে,বর্ণ থাকবে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকে থাকবে।এই ধরণী টিকে থাকবে মানুষের নেতৃত্বে।মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যুকে সঙ্গে করেই আমাদের বসবাস,আমাদের জন্মই হয়েছে মৃত্যুকে সঙ্গী করে।তবে সেই  মৃত্যু যেন না হয় মানুষের সৃষ্ট ফাঁদে। যত দিন বাঁচি সেই বেঁচে থাকাটা হোক সুন্দর। সেই লক্ষ্যে আমাদের সচেতনতা, সাবধানতা এবং একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্মান প্রদর্শন হওয়া উচিত বেঁচে থাকার মূল ব্রত।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা উচিত মানব বসতির শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার। 

কিন্তু কোথায় শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার চেষ্টা মানুষের?পৃথিবীর মানুষের এই চরম দুঃসময়ের মধ্যে দেখলাম দক্ষিণ কোরিয়ার শক্তিমত্তা প্রদর্শনের সামরিক মহড়া,ইয়েমেনের ভূখণ্ডে সৌদি আরবের সামরিক হামলা।মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, পৃথিবী নামক গ্রহের প্রাণ প্রকৃতির উপর মানুষের যে অবিরাম অত্যাচার এই দুর্যোগ হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধেরই অংশ। 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -২ ) 

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব -১)