সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট টিভি পর্দার মাধ্যমে সবার সামনে আসলেন।ফরাসি ভাষায় বললেন Nous somme en guerre অর্থাৎ আমরা যুদ্ধে আছি।এ যুদ্ধ এক অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে।এই যুদ্ধে জয়ী হতে সবাইকে ১৫ দিন ঘরে থাকতে অনুরোধ করলেন।ফার্মেসী,অতি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যসামগ্রীর দোকান ব্যতীত সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেন।বন্ধের কারণে প্রতিষ্ঠানের ভাড়া,ইলেকট্রিক বিল সহ ক্ষতি পূরণের আশ্বাস প্রদান করে বললেন এই কয়েকদিনের জন্য আমরা না খেয়ে মরে যাবনা।কয়েকটি শর্তে বাইরে বেরোনোর সুযোগও দিলেন।শর্তগুলোর মধ্যে ছিল,পেশাগত কারণ, ডাক্তারের দেখাতে ডক্টর চেম্বার বা হসপিটাল যাওয়া এবং ঔষদ কেনার জন্য ফার্মেসীতে যাওয়া,নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য সামগ্রীর জন্য মুদী দোকানে যাওয়া,স্বাস্থ্যগত কারণে হাঁটা বা দৌড়ানোর জন্য বাসার এক কিলোমিটারের মধ্যে দিনে একবার এক ঘণ্টার জন্য বাহির হওয়া, এই মুহূর্তে পেশাগত কারণে যাদের কর্মস্থলে থাকতে হবে তাদের বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য বাহির হওয়া ইত্যাদি। তবে সরকার প্রদত্ত নির্ধারিত ফর্মে কারণ উল্লেখ করে অবশ্যই সঙ্গে রেখে বের হতে হবে।অন্যথায়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী শাস্তি স্বরূপ ৩৮ইউরো জরিমানা করবে।লক ডাঊন সংক্রান্ত আইন কার্যকরের সময় নির্ধারিত হল ১৭ মার্চ দুপুর ১২:০০ থেকে।
কেনাকাটা করতে করতে ব্যাংক একাউণ্টের সর্বোচ্চ ক্রেডিট সীমা প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে।পরদিন সকালে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য বের হতে হল,প্রতিটি দোকানে মানুষের শেষ বেলার কেনাকাটার লাইন। সবাই বেশ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকের মুখে মাস্ক পরা।এতদিন মানুষ মাস্ক পরাকে কেউ গুরুত্ব না দিলেও আজ সবার মধ্যে বিশেষ সতর্কতা জেগে বসেছে। এজন্য মানুষকে দোষারোপ করলেও চলবেনা। কারণ সরকার বাজার থেকে হসপিটালের ডাক্তার, নার্সদের জন্য মাস্ক তুলে নিতে এতদিন একমাত্র অসুস্থ ব্যক্তি ব্যতীত অন্যান্যদের মাস্ক পরতে নিরুৎসাহিত করেছিল।এটা ছিল মূলত সরকারের একটি কৌশল।কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পর দোকান থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ভাবলাম,আর কিছুক্ষণের মধ্যে একটি আবদ্ধ জীবনে নিজেকে বাধতে হবে,দুদিন পরে প্রকৃতিতে বসন্ত নামবে, ইতোমধ্যে চেরি গাছগুলোর শাখা প্রশাখা ধোপা ধোপা ফুলে সাদা নীল হয়ে উঠেছে,নানা রঙ রূপ গন্ধে ডাটার বৃন্তে ফুটে আছে টিউলিব,বইছে শীতের বিদায়ী শীতল হাওয়া, গাছগুলোর কঙ্কালসার দেহের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নতুন সবুজ কচি পাতা।এমন একটি বসন্তের দিনগুলো কাটবে ঘরের চারকোণে সেই হতাশায় নিয়ে বাজার হাতে করেই বেরিয়ে পরলাম আশে পাশের পার্কগুলোর দিকে।প্রতিটি পার্কের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ।জনমানবহীন পার্কগুলো শুনশান নীরবতায় ফুলের মঞ্জুরি সাজিয়ে আছে, শুধু ওদের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নেই কোন প্রকৃতি প্রেমিক।
ঘরে আবদ্ধের প্রথম দিকের দিনগুলো শুরু হল অনেকটা আতংকের মধ্যে। দিনশেষে টেলিভিশনের পর্দায় সারা দিনের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত,মৃত্যু ,সুস্থ হওয়া মানুষের পরিসংখ্যান ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হন ফ্রান্সের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক Jérome Saloman।দিন শেষে টিভি পর্দায় অপেক্ষায় থাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনের।ভাবি, সমস্ত দেশ অবরুদ্ধ,চলছে সরকার নির্দেশিত গৃহবাস জীবন, হয়তো আজকের প্রতিবেদনে বলবে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমে গেছে,সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে,মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু হয়েছে, গুরুতর আক্রান্তের হার নিম্নমুখী।
কিন্তু, দিন যত সামনের দিকে যত এগুতে থাকে বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা,গুরুতর আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী,প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় নতুন সংখ্যা।ভাবি, কবে শেষ হবে এই আগ্রাসন, কেউ জানে না। সারা দিন বুকে মধ্যে বেঁচে থাকার যে সাহস সঞ্চার হয়, সন্ধ্যে নামলে হতাশার পাল্লা ভারী ওঠে।ভয় জেগে বসে, কার শরীরের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে এই মরণঘাতী ভাইরাস,কখন তার প্রকাশ ঘটবে, কেউ জানেনা......।
মাঝে মাঝে আমরা দুজনে বলাবলি করি, যদি এই ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় দুজনকে তাহলে কি হবে আমাদের নাবালিকাটির? প্রবাসে থাকি এখানে নেই কোন রক্তের আত্মীয় স্বজন, কোথায় ঠাই হবে ওর?
এমন সময়, একদিন ফেচবুকের একটি লেখা দারুণ ভাবে আহত করল।চীনের উহান শহরে একটি পরিবারের একজন বয়স্ক সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, পরে পরিবারের ছয় বছরের একটি শিশু ব্যতীত সবাই আক্রান্ত হয় এবং প্রাণ হারায়।বেঁচে যাওয়া শিশুটিকে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ হসপিটালের একজন নার্সের তত্ত্বাবধানে রেখে দেয়।প্রতিদিন নার্স শিশুটিকে কিছু খাবার, কাগজ কলম ও খেলনা দিয়ে একটি রুমে তালাবদ্ধ করে ডিউটি পালন করতে যায় এবং মাঝে মাঝে দেখতে আসে। শিশুটি খেলাধুলা করে কিন্তু তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নির্মমতার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে ফেলে আসা পারিবারিক সুন্দর দিনগুলোর স্মৃতি। বাবা মা, দাদা দাদী হারিয়েছে একটি অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে। এখন এই পৃথিবীতে সে আপনজনহীন।বিষয়টি অবুঝ শিশুটিকে দারুণ ভাবে আহত করে এবং চরম বাস্তবতা সে অনুধাবন করে।একদিন ডিউটির এক ফাঁকে নার্স শিশুটিকে দেখতে যায় তার রুমে। রুমে গিয়ে দেখে কয়েকটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজে পেনসিল দিয়ে আঁকা ছবি।ছবির চরিত্রগুলো দাদা দাদী, বাবা মা এবং করোনা ভাইরাস।একসময় শিশুটি বাবা মায়ের সাথে পার্কে যেত, সমুদ্র যেত।সেই দৃশ্যগুলো ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছে। ছবির চরিত্রগুলো দিয়ে বোঝানো হয়েছে, একসময় শিশুটির একটি গোছানো পরিবার ছিল,সবাইকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস ছিল।কিন্তু করোনা ভাইরাস তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে। শিশু মনের ভাবনাগুলো ভেসে উঠছে শিশুটির রঙ পেনসিলের আঁচড়ে।ছবিটিগুলো নার্স তার ব্যক্তিগত ফেচবুক পেজ থেকে পোষ্ট করার পর সারা পৃথিবী ব্যাপী ভাইরাল হয়ে যায়। শিশুটির এই হৃদয়স্পর্শী অংকন দারুণ ভাবে আহত করে সবাইকে।
হয়তো আমার আশেপাশের অনেক মানুষই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হসপিটালের বিছানায় কাতরাচ্ছে।জেনেছি, আমাদের পাশের ফ্লাটের এক আফ্রিকান বংশোদ্ভূত প্রতিবেশীর বাবা মারা গেছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। আশেপাশে জনমানবহীন ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজমান।মাঝে মাঝে বেলকনীতে দাঁড়ালে কানে ভেসে আসে এম্বুলেন্সের ছুটে চলার হর্ন।আমার বাসার সামনে বৃদ্ধাশ্রমের দাঁড়িয়ে থাকা ভবনেরর জানালায় জীবনের সায়াহ্নে আসা মানুষের নির্বাক দৃষ্টি।সব মিলিয়ে একটা হতাশার আবহ সৃষ্টি হয়ে আছে চারপাশে।লক ডাউন পূর্ব আমাদের বাইরের চলাফেরা ছিল স্বাভাবিক নিয়মে।মিশেলের স্কুল,স্ত্রীর এয়ারপোর্ট লাইনে ট্রেনের ভিড় মাড়িয়ে প্রতিদিনের অফিস,আমি ছুটিতে থাকলেও বাইরের প্রশাসনিক কাজকর্মে ছুটোছুটি ইত্যাদি।এর মধ্যে আমার স্ত্রী একবার মাথা ব্যথা ও অল্প জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে,যদি সামান্য ঔষদে সুস্থ হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমরাও যে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি তা আমাদের চিন্তার মধ্যেই রয়েছে।চরম এই অনিশ্চয়তার দিনে সৃষ্টিকর্তাকে বলি,
যদি নিয়ে যাও হঠাৎ করেই প্রভু তোমার কাছে,
নেই কোন আক্ষেপ তাতে,
রেখো অন্তত একজনকে এপারে,
যে আদর স্নেহ দিয়ে পথ দেখাতে পারে আমাদের অবুঝটিরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন