সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ,করণীয়, সতর্কতা ইত্যাদি সংক্রান্ত ভিডিও দেখে ও আর্টিকেল পড়ে কোভিড ১৯ সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে জানা বোঝা ইতোমধ্যে বেশ পোক্ত হয়েছে।
মার্চের মাসে প্যারিসের তাপমাত্রা সকালে পাঁচ ছয় ডিগ্রী দিয়ে শুরু হলেও দিন শেষে প্রায় পনেরো ষোলোতে গিয়ে ওঠে।সারা দিনের আবহাওয়ার তাপমাত্রার ওঠা নামার যে খেলা চলে তার প্রভাব মানুষের শরীরে গিয়ে পড়ে ।জ্বর সর্দী, গলা ব্যথা,কাশি এ সময়ের সাধারণ অসুখ।বেশ কদিন ধরে গলায় ব্যথা অনুভব করছি,মাঝে শুষ্ক কাশি, কখনো নিশ্বাস নিতে গেলে বুকের ডান পাশে অস্বস্তি অনুভব করি।বারবার চা পান করি।ঠাণ্ডা জল বাদ দিয়ে এখন নিয়মিত গরম পানি পান করছি,তবুও কাশি,গলা ব্যথা দূর হচ্ছে না।ভেতরে অজানা আতংক মাঝে মাঝে দারুণ ভাবে ভর করে।বাধ্য হয়েই ইন্টারনেটে আমার ব্যক্তিগত ডাক্তারের একটি সাক্ষাকার সময় নিলাম।এর মধ্যে সাধারণ জ্বর ঠাণ্ডা জনিত অসুখের রোগীদের ডাক্তাররা সশরীরে দেখা বন্ধ করে দিয়েছে।ডক্টর চেম্বারের অভ্যর্থনা থেকে কেউ একজন ডাক্তারের পূর্বে ফোন করে জানতে চায় কি সমস্যার জন্য সাক্ষাতকার চাচ্ছি।সমস্যা শুনে অভ্যর্থনা থেকেই বলে দেয় সরাসরি ডাক্তারের কাছে যেতে পারব কিনা। যাইহোক, আমার সমস্যা বলার পর ডক্টর চেম্বারে যাওয়ার অনুমতি মিলল না, বললেন ডাক্তার আপনাকে ফোন করবেন।১৯ মার্চ বেলা এগারোটার সময় আমার ডাক্তারের ফোন এলো।জানতে চাইলও আমার শারীরিক সমস্যার কথা।সবকিছু বর্ণনার পর কোন প্রেসক্রিপশন না দিয়ে বলল,ফ্রান্সে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিদ্যমান,সুতরাং আপনার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,যেহেতু আপনার শরীরে সবগুলো উপসর্গ এখনো প্রকাশ পায়নি তাই ১৪ দিন বাজার করা ও জরুরী কোন কাজে বাইরে না যাওয়া, পরিবারের অন্য সদ্যসদ্যের থেকে আলাদা থাকা ইত্যাদি পরামর্শ দিলেন এবং কোন সমস্যা অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন।এও বললেন, আপনার মেয়ে ভাইরাস বহন করে নিয়ে আসতে পারে, কারণ বিভিন্ন পরিবারের অনেক বাচ্চা একসঙ্গে সারাদিন স্কুলে অবস্থান করে।
তাৎক্ষণিক ডাক্তারের কথা শুনে একটু হোঁচট খেলাম।ডাক্তার বর্তমান প্রেক্ষাপটের বাস্তবতা অনুধাবন করে আমার দেহে করোনার সংক্রমণ সন্দেহ করছে, কিন্তু দেহটাতো আমার নিজের,ভেতর থেকে বলছে আমি করোনা ভাইরাসে এখনো সংক্রমিত নই।আমার স্ত্রী বেশ সাহস যোগাল।বলল, ভয়ের কারণ নেই,এখনো সবগুলো উপসর্গ তোমার শরীরে নেই, অপেক্ষা করো।
আমিও ভাবলাম, যাই হোক মনোবল শক্ত রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবো।মরার আগে মরে গেলে চলবে না। পৃথিবীটা আসলেই নিরাপদ জায়গা নয়। আজ এখানে করোনা আঘাত হেনেছে,তাই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মরছে আবার সুস্থও হচ্ছে।কিন্তু সারা পৃথিবীতেইতো প্রতিদিন নানা দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে।যে মানুষগুলো হয়তো সকালের সূর্য ওঠার পর জানেনা আজই তার জীবনের শেষ সূর্য উদিত হয়েছে, আর কোন দিনই চোখের দৃষ্টিতে ধরা দেবে না এই ধরণীর আলো,সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য।তবুও মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠে বেঁচে থাকার আশায়।কিন্তু মানুষের বানানো মৃত্যুর ফাঁদে পড়ে অকালে প্রাণ দিতে হয় কত মানুষকে।
পৃথিবীতে কয়েক বছর পর পর কোননা কোন নতুন ভাইরাসের আক্রমণে অসংখ্য মানুষ মৃত্যু বরণ করে।কোন এক সময় প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়।ভাইরাসের ভয়ংকর আক্রমণ কোন এক সময় মানুষ প্রতিহত করতেও সক্ষম হয়।কিন্তু, প্রথম দিকে ভাইরাসের অতর্কিত হামলায় অপ্রস্তুত থাকায় অসংখ্য মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়।ভাইরাসের কথা বাদ দিলাম।যখন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ট্রেন, বাস, বিমানে উঠি, যতক্ষণ পর্যন্ত না গন্তব্যে পৌঁছাই ততক্ষণই মৃত্যু আমাদের পাশাপাশি বসেই অবস্থান করে। কারণ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে যে কোন মুহূর্তে মৃত্যু আঘাত হানতে পারে।আমাদের সারা জীবনের পড়াশুনা ,সুন্দর জীবিকা, পরিপাটি বাড়িঘরে বসবাস,ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কত কিছু নিয়েই না আমরা জীবন যাপন করে থাকি, অথচ যে কোনো সময় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের ভয়ংকর থাবায় আমাদের সাজানো গোছানো জীবন মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যা আমাদের চলমান বিশ্বের প্রাত্যহিক ঘটনা।কত শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর পৃথিবীতে কয়েক বছর অবস্থান করে পূর্ণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ ছাড়াই বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।ভাইরাসের কারণে মৃত্যু ভয়, অথচ আমরাই প্রতিদিন অধিক মুনাফার আশায় খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে ভেজাল মিশিয়ে একে অপরের জন্য প্রতিদিন মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করে রাখছি।পৃথিবীটা মানুষের জন্য অথচ এই পৃথিবীটাকে অনিরাপদ করার জন্য মানুষই প্রধানত দায়ী। প্রতিদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এক ধর্মের মানুষ খুন করছে অন্য ধর্মের মানুষকে,এক রাষ্ট্র হামলা চালাচ্ছে অন্য রাষ্ট্রের উপর,বর্ণবাদী সহিংসতায় এক বর্ণের মানুষ খুন করছে অন্য বর্ণের মানুষকে।কিন্তু, করোনা ভাইরাসের বিশেষ প্রীতি নেই বিশেষ কোন ধর্ম,বর্ণ বা রাষ্ট্রের প্রতি।অদৃশ্য করোনা ভাইরাস যুদ্ধ ঘোষণা করছে পৃথিবীর দৃশ্যমান মানুষের সঙ্গে।সুতরাং পৃথিবীর ঐ সব দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা ভাবার কোন কারণ নেই।একটি উন্নত দেশের বাসিন্দা হলেও একটি অনিরাপদ পৃথিবীর মানুষও আমি।উন্নত দেশের চিকিৎসা, অর্থ,বিত্ত,সর্বাত্মক চেষ্টা, সব কিছুকে পরাস্ত করে প্রতিদিন করোনা ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ।জীবনকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার কাছে সবকিছুর মূল্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে আজ।জীবন যদি না থাকে তাহলে কি মূল্য রয়েছে প্রাণহীন জড় প্রাচুর্যের।প্রাণই যে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ তা বর্তমান সময়ের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।তবে করোনা ভাইরাসের আগমন এমন সময়ে, যখন বিশ্বের অর্থ অস্ত্রে শক্তিশালী দেশগুলো নিজ দেশের মানুষের জৌলুশপূর্ণ জীবন যাপন নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়ে অন্য দেশের মানুষকে বাস্তুহারা করে দিচ্ছে।ঠিক সেই মুহূর্তে করোনা তার তাণ্ডবের মাঝে পৃথিবীর সমগ্র ধর্ম, গোত্র,বর্ণ ও রাষ্ট্রের মানুষকে একত্রিত করে একটি বার্তা দিয়ে যাচ্ছে, তাহলো, পৃথিবীতে শুধু একা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম নয়, সংগ্রাম হবে পৃথিবীর সমগ্র মানুষের সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার সম্মিলিত সংগ্রাম।মানুষ বাঁচলেই ধর্ম থাকবে,বর্ণ থাকবে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকে থাকবে।এই ধরণী টিকে থাকবে মানুষের নেতৃত্বে।মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যুকে সঙ্গে করেই আমাদের বসবাস,আমাদের জন্মই হয়েছে মৃত্যুকে সঙ্গী করে।তবে সেই মৃত্যু যেন না হয় মানুষের সৃষ্ট ফাঁদে। যত দিন বাঁচি সেই বেঁচে থাকাটা হোক সুন্দর। সেই লক্ষ্যে আমাদের সচেতনতা, সাবধানতা এবং একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্মান প্রদর্শন হওয়া উচিত বেঁচে থাকার মূল ব্রত।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা উচিত মানব বসতির শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার।
কিন্তু কোথায় শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার চেষ্টা মানুষের?পৃথিবীর মানুষের এই চরম দুঃসময়ের মধ্যে দেখলাম দক্ষিণ কোরিয়ার শক্তিমত্তা প্রদর্শনের সামরিক মহড়া,ইয়েমেনের ভূখণ্ডে সৌদি আরবের সামরিক হামলা।মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, পৃথিবী নামক গ্রহের প্রাণ প্রকৃতির উপর মানুষের যে অবিরাম অত্যাচার এই দুর্যোগ হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধেরই অংশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন