কয়েক দিনের স্বেচ্ছা নির্বাসন ভেঙ্গে শরীরটাকে একটু চাঙা করার জন্য দৌড়াতে বাইরে বের হতে উদ্যত হলাম।ঘরের দরজা পার হতেই ভেতরে কেমন যেন এক অবিশ্বাস জেগে বসলো। মনে হল, বাইরের খোলা প্রকৃতি, বিল্ডিঙয়ের লিফট থেকে আরম্ভ করে বের হওয়ার দরজা, প্রতিটি জিনিস যেন বিশ্বস্ততা হারিয়েছে।কিছুদিন আগেও যে প্রবেশ দরজার হাতল, লিফটের বোতাম ধরতে কোন দ্বিধা ছিলোনা।এখন কেন যেন সবকিছুকেই ঘাতক মনে হয়।সন্দেহ হয়, কারো স্পর্শে লিফটের বোতামে,দরজার হাতলে লেগে আছে ভাইরাস।যতবার স্পর্শ করি ততবার হাতে স্যানিটারি জেল মেখে সন্দেহ দূর করতে হয়।
অনেকদিন পর রাস্তায় নেমে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা বিশালতায় ভরে গেলো।ধীরে ধীরে দৌড়াচ্ছি আর চার পাশের পরিবেশ দেখে চেনা শহরকে অচেনা লাগছে।প্রায় জনমানবশূন্য রাস্তা। কয়েকটি এম্বুলেন্সের ছুটে গেলো সাইরেন বাজাতে বাজাতে। যে রাস্তা এক সময় দখলে ছিল বাস,প্রায়ভেট কারের এখন সেই রাস্তায় এম্বুলেন্সের একার রাজত্ব।রাস্তার ধারের ডাস্টবিনগুলো ময়লা উপচিয়ে আছে মেরী দো পারি’র নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের বিরতির কারণে।কিছু বয়স্ক মানুষ মাস্ক পরে পোষা কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে,চলার পথে কেউ পাশাপাশি হলে উভয়েরই দূরে সরার চেষ্টা। সবার চোখে সন্দেহ, হয়তো পাশের পথ চলা মানুষটির শরীরে রয়েছে করোনা ভাইরাস।
এভাবে পরপর দুদিন রাস্তায় বের হলাম দৌড়াতে।শরীরটা হালকা মনে হল, শ্বাসপ্রশ্বাস আগের থেকে আরও ভালো অনুভব হচ্ছে।ডাক্তার প্রতিদিন নিশ্বাস বন্ধ করে সংখ্যা গুনতে বলেছে সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য। আগে ত্রিশ পর্যন্ত গুনতে পারতাম,দুদিন দৌড়ানোর পর চল্লিশ পর্যন্ত গুনতে পারি।কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত রিপোর্ট আর টিভি সংবাদ হতাশা বাড়াতে লাগলো।হসপিটালে বেডে করোনা রুগীর চিকিৎসার পাশাপাশি কফিনও প্রস্তুত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এমন দৃশ্য দেখে পৃথিবীটাকে খুব নশ্বর মনে হতে লাগলো। মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা মনের উপর দারুণ প্রভাব ফেলত লাগলো। প্রতিদিন ছয় সাতশো মানুষের মৃত্যুর সংবাদ স্বাভাবিক চিন্তাধারার উপর এক কালো ছায়া ফেলো দিলো।মনে হল, জীবনটা এখন লটারি হয়ে গিয়েছে। এই করোনা ঝড় পরবর্তী পৃথিবীতে বেঁচে থাকা ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে।মনে হল, বেঁচেই থাকার আশা যদি এতো দোদুল্যমান হয়ে যায় তাহলে ভালোভাবে বেঁচে থাকার পরিকল্পনায় পরিশ্রম করে কি লাভ। মনের মধ্যে এমন শঙ্কা জেগে বসলো, মনে হল যে কদিন বাঁচি অবশিষ্ট শ্বাস প্রশ্বাসের স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকি ।
জুন থেকে সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষার একটি কোর্সের উপর আমার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা।ভাষা কোর্স শেষ করার পর ফ্রেঞ্চ একাউন্টেন্সি উপর একটি পেশাদার কোর্স করার পরিকল্পনা রয়েছে।সে জন্য কোর্সটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসার বসে বেশ প্রস্তুতিও চলছিলো।এই কোর্সটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একটি স্বপ্নের বীজ।কোর্সটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারলে স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হবে। চলমান হতাশার দিনগুলোতে জীবনের সমস্ত স্বপ্নগুলো যেন ফিকে হয়ে আসতে লাগলো।জীবনের আশা মানুষের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে।যেখানে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে, সেখানে স্বপ্নগুলোও যেন ম্লান হতে থাকে।আমার ক্ষেত্রও এমন অনুভূতি দারুণ ভাবে চেপে বসলো।পড়াশুনা ছেড়ে দিলাম।মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী এসে বলে, এখন আর ফ্রেঞ্চ কোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছনা যে, আমি বলি জীবন থাকলে ফ্রেঞ্চ কোর্সের প্রয়োজন রয়েছে, জীবনের আশা যখন এতো ক্ষীণ তখন ফ্রেঞ্চ পড়ে কি হবে? বরং পারিবারিক সময়গুলো উপভোগ করি।
করোনার কারণে ভালো যে ব্যাপারটি ঘটলো তাহলো আমরা তিনজন এখন চব্বিশ ঘণ্টা এক সাথে কাটাচ্ছি।মেয়ে সাথে খেলছি।ওর অন্য কোন সঙ্গী না থাকায় আমার সাথেই ওর ঝগড়া ,আবার মিল হয়ে গেলে খেলাধুলা।প্রতিদিন ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে মিশেল সিনেমা হল বানায়,আমাকে এবং তার মাকে ডেকে নিয়ে তার বানানো সিনেমা হলের চেয়ারে বসায়, সিনেমার সঙ্গে খাবার ব্যবস্থা রাখে বাদাম ও মুড়ি।তার পর কম্পিউটারে ইউটিউব থেকে চালিয়ে দেয় তার পছন্দের কোন নাটক বা সিনেমা।কয়েক দিন চলল ওর সাথে আমাদের সিনেমা সিনেমা খেলা।
ওর সাথে যখন খেলাধুলা করি তখন আমার মধ্যেও শিশু ভাব জেগে ওঠে।
মিশেলকে আমি প্রথম দেখেছি ওর তিন বছর বয়সে প্যারিসের শার্ল দ্য গোল এয়ারপোর্টে। এর পূর্বের পুরো সময় কাটিয়েছে তার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে। আমি যখন ফ্রান্সে চলে আসি তখন সে পৃথিবীতে অনাগত,মায়ের গর্ভে অবস্থান নিয়েছে মাত্র।স্বভাবতই, আমার চেয়ে তার মায়ের প্রতি টানটা একটু বেশী।এখানে আসার পর আমার পাশে শুয়ে কখন ঘুমায়নি, কিন্তু এই গৃহবন্দী সময় তার সাথে আমার সখ্যতা একটু বেশীই হয়ে গেলো।অনেক সময় তার মায়ের থেকে আমার সাথেই বেশী সময় কাটে।ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তাই আমার শাসন তার কাছে গুরুত্ব পায়না। আমিও শাসন করতে যাই না। উল্টো আমার বিরুদ্ধে সারাদিন অভিযোগ চলে তার মায়ের কাছে, বাবা আমাকে এটা করেছে, ওটা করেছে।তার মা ই একমাত্র শাসন বাঁধন দিয়ে তাকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখে।
এখন তার সকালে স্কুলের তাড়া নেই, রুটিন মাফিক ঘুমানোর সময় নেই। সব নিয়ম কানুন ভেঙে পড়েছে।তার মধ্যেও অনিয়মের মজা দারুণ ভাবে ভর করে বসেছে। অনিয়ম করার নতুন নতুন ফন্দি তার মাথায় খেলা করে, আর আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বলে।কারণ ফন্দিগুলো বাস্তবায়ন করতে আমার প্রয়োজন, তার মায়ের সাথে করা কখনোই সম্ভব নয়।একবার নতুন একটি ফন্দি আঁটল সে, তার মা রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লে আমি আর সে ড্রয়িং রুমে চলে আসবো,তার পর মোবাইলে গেম খেলবো,কার্টুন দেখবো আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে তার।
তার পরিকল্পনা মত আমি রাজি হলাম। আমি ভাবলাম এমনিতেই বলছে রাত্রে ভুলে যাবে।কিন্তু সত্যিই মধ্যরাতে পিনপতন নীরবতায় আমাদের রুমে এসে আমার কানে ফিস ফিস করে বলছে, বাবা উঠো,বাবা উঠো।তার মা ঘুমিয়ে ঘোরে চলে গেছে, আমি আর সে পা টিপে টিপে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম।ফ্লোরে বিছানার আয়োজন করলাম।মিশেল জানালার কাছে গিয়ে পর্দা টেনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি দেখল। ভয় পাবে বলে আমি তাকে ঘুমোতে বললাম, কিন্তু সে বলল তুমি ঘুমাও বাবা, আমি রাত দেখি।আমি বেশী কিছু বললাম না। মনে হল, প্রকৃতিকে নতুন রূপে আবিষ্কারের কৌতূহল জেগেছে তার মধ্যে।নিজের মত করে এভাবে তার রাত দেখা হয়নি কখনো তাই নিস্তব্ধ রাতের প্রকৃতি তাকে বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করছে।ওর মধ্যে আমরা কখনো ভয় জাগায়নি, ভয়ের গল্পও করিনা কখনো, তাই ওর মধ্যে অবাস্তব ভূতের ভয় নেই।
ছোট বেলায় আমরা রাতকে ভয় পেতাম, কারণ ঐ সময় বড়রা ভূতের গল্প করত, রাতে ভূত পেত বের হয়, তারা মানুষ খায়,এমন অবাস্তব গল্প শুনে শুনেই আমরা বড় হয়েছি। এই ভয়ে সন্ধ্যে নামার পর থেকে ছেলে বেলায় একলা থাকতে ভয় লাগতো।রাতে আমি নিজের ছায়া দেখে ভয় পেতাম। আমার মনে হতো এই ছায়াটাই বুঝি ভূত। আমাদের বড়রা যদি আমাদের ছেলেবেলায় ভূতের গল্প না করে, রাতের সৌন্দর্য বর্ণনা করত তাহলে হয়তো রাতের ভীতি আমাদের মধ্যে তৈরি হতো না।রাতের আকাশে তারা ঝিকমিক করে, চাঁদ জোছনা ছড়ায়,ঝিঝি পোকা ডাকে, জোনাকিরা মৃদুমন্দ আলো ছড়িয়ে উড়ে বেড়ায়।ভূত পেতের পরিবর্তে মূলত রাতের এমন সৌন্দর্যের বর্ণনাগুলো যদি আমাদেরকে করা হতো তাহলে আমাদের ছেলেবেলায় রাতের ভীতি তৈরি হতোনা।ভীতি একটি শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নিজের সন্তানের মধ্যে তাই অবাস্তব ভূতের ভীতি তৈরি করিনি। তাই গভীর রাতের নিস্তব্ধতা আমার মেয়েকে ভয় না জাগিয়ে বরং মুগ্ধ করেছে।
এই প্রথম অনিয়ম করে মিশেলের সাথে গভীর রাতের একটি সুন্দর আড্ডা হল,সেইসাথে পার হল বাপ মেয়ের প্রথম একত্রিত একটি স্মৃতিময় ঘুমের রাত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন