আমরা জানি, নিজের জীবন বিসর্জন দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন সৈনিকের।দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তার জীবন যে কোন মুহূর্তে উৎসর্গিত হতে পারে এটা জেনেই একজন মহৎ সাহসী তরুণ তরুণী সৈনিকের পোশাক গায়ে পরিধান করেন।সামনে শত্রু,তাদের রুখতে হলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে,বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারে শরীর,পৃথিবীর আলো বাতাস হয়তোবা এ জীবনে আর নাও জুটতে পারে, এসব ভাবনাকে তুচ্ছ করে একজন সৈনিক দেশের জনগণের স্বার্থে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংসের লক্ষ্যে এগিয়ে যায় পেশাগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে।যে জীবন অন্যের রক্ষার কাজে নিয়োজিত,এর থেকে মহৎ জীবন আর কার হতে পারে।এমন জীবনের অধিকারী মানুষ জীবিত অথবা মৃত উভয় অবস্থায় সম্মানিত।
চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও তাদের সহযোগীদের পেশাগত দায়িত্ব মানুষের সেবা শুশ্রূষা দিয়ে অসুস্থতার কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেয়া।আমরা বলে থাকি এটি একটি মহান পেশা।কিন্তু এই মহত্ত্বের গভীরতা বা সীমারেখা যে কতটা সুদূর প্রসারী, তা নিবিড় ভাবে অনুধাবনের সুযোগ খুব কম আসে।আমার ব্যক্তিগত মতামত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পেশাগত মহত্ত্বের সীমারেখা অসীম।কারণ,মানুষ একটি জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে।দুইবারের জন্য নয়।সেই জীবনকে সে সুস্থতার সহিত রোগভোগ মুক্তভাবে পরিবাহিত করতে চায়। কিন্তু ধূলা ময়লা,জীবাণু ভরা প্রাণ প্রকৃতি,যুদ্ধ বিগ্রহ,একে অন্যের দ্বারা নৃশংস হামলা,ভেজাল খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ,বার্ধক্য সহ নানা কারণে রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করতে হয় আমাদের।জীবনের এমন কঠিন ও ভয়াবহ সময়ে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের শিয়রের পাশের এসে দাঁড়ায় কোন চিকিৎসক।তাদের অর্জিত জ্ঞানের আলোকে পরামর্শ ও সেবা নিয়ে সুস্থ সবল হয়ে উঠি।নবজীবন নিয়ে আবার এই ধরণীর আলো বাতাসের স্বাদ উপভোগ করি আমরা।
একজন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত জীবন অন্য সবার মত।সেও নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য নিরাপদ জীবন যাপন করতে চান। কিন্তু একজন চিকিৎসক,নার্স ও তাদের সহযোগীদের কখনো কখনো একজন সৈনিকের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া লাগতে পারে,তা আমরা এতদিন গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখিনি।কিন্তু সময়ের বাস্তবতায় আমাদের আজ সেভাবে দেখতে হচ্ছে।
১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে।এই যুদ্ধে একদেশ অন্যদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না।এই যুদ্ধে নেই কোন বোমারু বিমান,রাইফেল, গোলাবারুদের ব্যবহার।এই যুদ্ধের সৈনিকদের পরতে হচ্ছেনা চক্রবক্র সমর পোশাক ও ভারি হেলমেট।কারণ এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ অদৃশ্যমান একটি ভয়ংকর শক্তিশালী জীবাণু,নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯।যা দৃশ্যমান গোলাবারুদের চেয়োও ভয়ংকর।কারণ এর তাৎক্ষণিক আক্রমণ প্রতিহতের কৌশল মানুষের আজ অজানা।এক মাত্র কৌশল, সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে পথচলা। মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে তার আবির্ভাব।শুধু একজন জীবাণুবাহী মানুষের স্পর্শ অন্যের জীবনকে বিপন্নের সম্মুখীন করতে সক্ষম এই জীবাণু।আর এভাবেই তার আগ্রাসী বিচরণ আজ সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে।এপ্রিল ২০২০ এর মধ্যেই এই অদৃশ্য শত্রুর দানবীয় আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ। হসপিটালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাটছে অনেক মানুষের জীবন।যাদের শরীরে অবস্থান নিয়েছে এই অদৃশ্য দানব তাদের দিন কাটছে মৃত্যু আতংকে। ভীতির কারণে থমকে গেছে অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা। চীনের উহান,ইতালির জনপদকে করেছে ভূতুড়ে বিরানভূমি, ফ্রান্স,ইংল্যান্ড,আমেরিকা ও স্পেনে এই সময়ে চলছে নৃশংস তাণ্ডব।এখন কারো ভাবনায়, করোনা আগ্রাসন পরবর্তী পৃথিবীতে সুযোগ মিলবে কি নতুন করে বেঁচে থাকার? পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সরকার তাদের জনগণকে রক্ষার জন্য করেছে গৃহবন্দী এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইচ্ছে করলেই যে কেউ সমরের ঝুঁকিপূর্ণ অগ্রভাগে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।কারণ এই যুদ্ধের অগ্রভাগের সৈনিক হতে পারবে তারাই যারা চিকিৎসা বিদ্যায় জ্ঞান অর্জনকারী বিশেষ মানুষ।অর্থাৎ, ডাক্তার এবং নার্স।পৃথিবীর মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাসের যে লড়াই চলছে, সেই লড়াইয়ে মানুষের জয় নিশ্চিত করতে আমাদের সাধারণ মানুষকে পেছনে রেখে অগ্রভাগে অবস্থান নিয়েছে ডাক্তার ও নার্স পেশার সময়ের সাহসী মানুষেরা।চলছে বিরতিহীন যুদ্ধ,ভয়াবহ এই সমরে বিরামহীন ভাবে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা তাদের।ক্লান্ত দেহ তবুও মস্তিষ্ক ও দেহের সবটুকু উজাড় করে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাবার আত্মপ্রত্যয়ে শত্রুকে পরাস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা।
আমি একজন ফ্রাঙ্কোবাংলাদেশী।প্রায় দশ বছর ধরে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস।ফ্রান্স সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, ফরাসি ভূখণ্ড হল মানবতার চারণভূমি।এই দেশে বসে স্বচক্ষে যেভাবে দেখছি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফ্রান্স প্রশাসনের লড়াইয়ের কৌশল ও রণাঙ্গনে টিকে থাকার সংগ্রামে শক্তির ব্যবহার, তার আলোকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিজের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীকে অনুভূত হয়েছে উল্লেখিত বর্ণনার মত।কিন্তু,প্রকৃত সত্য এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত দেশের লড়াইয়ের ধরণ, কৌশল একই ভাবে চলছেনা। এটা নির্ভর করছে ওই দেশের জনসংখ্যা,আর্থিক সক্ষমতা,রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সমাজ ব্যবস্থা,জাতি গোষ্ঠীর মানুষের চিন্তাধারা ইত্যাদির উপর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন