যেদিন ফ্রান্সের খেলা থাকে সেদিন শহরের বারগুলোতে ফুটবল প্রেমীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। কারো অবসর সময় থাকলে বাসার টিভি পর্দায় খেলার আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু, খেলাকে কেন্দ্র করে অতিরঞ্জিত কোন কার্যকলাপ কখনো লক্ষ্য করা যায় না। কারণ, ফরাসিদের নানা আনন্দ উৎসবের মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফুটবল একটি মাধ্যম মাত্র।এছাড়া, এখানকার প্রত্যেকের জীবন যাপনে প্রথমে গুরুত্ব পায় নিজের জীবিকা অর্জনের কর্ম,এরপর অন্যকিছু। যার কারণে কোন কিছুতেই ফরাসিদের মধ্যে আদিখ্যেতা পরিলক্ষিত হয়না।
গতবার যখন বিশ্বকাপ জিতল তখন একদিন প্যারিসের বিখ্যাত এভেনিউ শঁজেলিজেতে একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফরাসীরা একত্রিত হয়ে উল্লাস করেছে।এরপর ফুটবল উন্মাদনা ঝেড়ে ফেলে যার যার কর্মে মনোনিবেশ করেছে।এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সপ্তাহ ব্যাপী অতিরঞ্জিত উৎসব আনন্দ করে সময় নষ্ট করেনি।
ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশ ফুটবল দল কখনো অংশগ্রহণ করেনি এবং আমাদের জীবদ্দশায় করবে কিনা তা সন্দিহান। অথচ, প্রতিটি বিশ্বকাপ আসলে বাংলাদেশে ভিনদেশে ফুটবল দলকে সমর্থন করে যা হয়, তা আমাদের জাতিগত মানসিকতা নিয়ে ভাবনায় ফেলে দেয়।আমরা ভিনদেশি দলগুলোকে নিয়ে যে কার্যকলাপগুলো করি তার কিঞ্চিত পরিমাণ ঐ সব দেশের মানুষ তাদের দলকে নিয়ে করে কিনা আমি সন্দিহান। ফেচবুকে চোখ রাখলে ভেসে আসে এই ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে সব অদ্ভুত সংবাদ।কেউ জমি ও স্ত্রীর গহনা বিক্রি প্রিয় দলের জন্য তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পতাকা টাঙ্গিয়ে তাক লাগিয়েছে, কোন আর্জেন্টিনা সমর্থক চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পতাকা টাঙ্গানোয় ব্রাজিল সমর্থক ঋণ করে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পতাকা টাঙ্গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।কেউ একজন ব্যক্তিগত অর্থ খরচ করে কাতারের ফুটবল স্টেডিয়ামগুলোর আদলে ডামি স্টেডিয়াম বানিয়ে ফেলেছে, কেউ প্রিয় দলের জন্য মোল্লা পুরোহিত দিয়ে প্রার্থনার আয়োজন করছে, কেউবা বাড়ীর বিল্ডিং ভিনদেশি পতাকার আদলে রং করে ফেলেছে।খেলা থেকে আনন্দ নেবার কথা,কিন্তু প্রশ্ন সবার কাছে, এসব অনুৎপাদনশীল কার্যকলাপের মধ্যে মানসিক আনন্দ ছাড়া আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাড়তি কি অর্জন নিহিত রয়েছে? এসব খবর আবার জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করছে,সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রচার বাড়ানোর লক্ষ্যে। যেখানে সংবাদপত্রের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে এসব অনুৎপাদনশীল কার্যকলাপকে প্রচার না করে নিরুৎসাহিত করার কথা।রক্ত দিয়ে পাওয়া নিজের স্বাধীন দেশে যে উপলক্ষেই হোক না কেন ভিনদেশী পতাকা উড়ানো যে সম্মানের বিষয় নয়, এই সামান্য সম্মান বোধটুকুই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের আমরা নিজেদের মধ্যে তৈরি করতে পারিনি। জাতিগত ভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ যে অবরুদ্ধ তা এ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়।জাতীয় পতাকা হচ্ছে একটি দেশ ও জাতির পরিচয় ও সম্মানের প্রতীক।নিজের স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ফুটবল ভালোবাসার নামে ভিনদেশি পতাকার মহোৎসব করা মানে নিজের পতাকাকে অপমান করা,নিজের সত্ত্বাকে অপমান করা।তা আমাদের উপলব্ধি করা অতীব জরুরি।
যেসব দেশের দল এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করছে সেইসব দল ও দেশের মানুষ সম্মান পাবে, আর্থিক পুরষ্কার পাবে, তাদের বাড়াবাড়ি আনন্দ উল্লাস মেনে নেয়া যায় , কিন্তু ভিনদেশী দল নিয়ে আমাদের যে বাড়াবাড়ি তা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া অন্যকিছু ভাবা না যায়না। এগুলো করে খেলা চলাকালে মানুষের মূল্যহীন সস্তা বাহবা পাওয়া যাবে, কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার পর ঋণ করে পতাকা বানানোর টাকাতো নিজেকেই পরিশোধ করতে হবে। এমন ভালোবাসার প্রতিদান স্বরূপ আপনার ঋণের দায়ভারতো ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা সরকার নেবে না।
কোন কিছুর প্রতি অবশ্যই ভালোবাসা থাকবে,উন্মাদনা থাকবে এবং থাকাটা অবশ্য ভালো, তবে তা হওয়া উচিত সীমার মধ্যে, শৃঙ্খলার মধ্যে, আত্মমর্যাদা বোধের মধ্যে।লাগামহীন অবশ্যই নয়।আমাদের মূল্যবান মেধা, শ্রম ও অর্থ যদি অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের চর্চা বন্ধ করে উৎপাদনশীল কর্মে ব্যবহারের অনুশীলন শুরু করি তবেই আমাদের জাতিগত অগ্রগতি তরান্বিত হবে এবং তার মধ্যেই আমাদের সামগ্রীক কল্যাণ নিহিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন