বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০২৩

মানুষের অপ্রত্যাশিত পার্থিব প্রাপ্তির পরিণাম

মানুষ জীবনের যে কোন  পর্যায়ে তার প্রত্যাশার থেকে প্রচুর অর্থের অধিকারী হতে পারে, কখনো অকল্পনীয় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে, আবার কখনো যোগ্যতার চেয়েও বড় পদের ভার নিজের উপর পড়তে পারে,দৈবক্রমে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাও দুয়ারে হাজির হতে পারে।


এমন সময়ে অধিকাংশ মানুষই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।ফলে, ন্যায় নীতি ও মনুষ্যত্ব জ্ঞান হারিয়ে আচরণে বন্য হিংস্র প্রাণিতে পরিণত হয়ে ওঠে।ক্রমাগত এমন ঔদ্ধত্য আচরণের ফলে একটা সময় তার চারপাশের মানুষের মনে তার প্রতি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার উদ্ভব হতে থাকে।এতে ঝড়ের গতিতে উত্থান হওয়া মানুষটা একটা সময় জনবিছিন্ন হতে থাকে। এক পর্যায়ে আত্মবিশ্বাস হীনতা জেগে বসে ।তখন অর্থ ক্ষমতা ও পদ থাকলেও সে আর এসবের মধ্যে সুখ খুঁজে পায় না।জীবনটাকে তার কাছে  অন্তঃসারশূন্য  মনে হতে থাকে। তখন তার প্রকৃত উপলব্ধি জ্ঞান ফিরে আসলেও মানুষের অন্তরে আর পুনরায় প্রবেশের  সুযোগ থাকে না।পরিশেষে এমন মানুষের সমাজে আবির্ভাব ঘটে শুধুই একটা পদার্থ রূপে।


যারা প্রাজ্ঞ ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ তারা পার্থিব প্রাপ্তির এই সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আরও ধিরস্থিরসম্পন্ন ও বিনয়ী মানুষ হয়ে ওঠে।কারণ, তাদের মধ্যে এই নশ্বর জীবন ও জগতের গতি প্রকৃতির জ্ঞান থাকার কারণে জগতের এই পার্থিব প্রাপ্তি কখনোই মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার থেকে বড় হয়ে উঠতে পারেনা। ফলে,জীবনের কোন এক পর্যায়ে জগতের পার্থিব অর্জন ও মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা মিলে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মহান হয়ে ওঠেন।পৃথিবী থেকে প্রস্থানের পর এরা হয়ে ওঠেন জ্বলজ্বলে এক ধ্রুবতারা,আপামর মানুষের আদর্শ।  



রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩

প্রসঙ্গ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

দেশের যে মানুষটা আওয়ামী লীগ করে, বি এন পি করে , জামাত করে,বাম রাজনীতি করে, পুলিশের চাকুরী করে, সাংবাদিকতা করে এরা কেউ অন্য দেশের মানুষ নয়, সবাই বাংলাদেশের ভূমিতে  জন্ম নেয়া মানুষ। মতাদর্শ ও পেশাগত কারণে যার যার অবস্থান ও দায়িত্ব ভিন্ন হতে পারে কিন্তু কেউ কারো শত্রু নয়। কারো আধিপত্য  প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে কাউকে শত্রুর সাড়িতে দাড় করিয়ে  খুনাখুনির জন্য উদ্যত হওয়া মানে নিজের দেশকে খুন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা,দেশের মানুষকে  ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। দেশের মানুষকে সঠিক ভাবে পরিচালনা জন্য আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে একটি প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে। সেই প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ দেশে জন্ম নেয়া প্রতিটি ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার।একটি রাজনৈতিক ও  গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যও দিয়ে যে কেউ সেই দায়িত্বের গ্রহণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে যদি কেউ পেশী শক্তি ও তৃতীয় শক্তির সহায়তায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের চেষ্টা চালায় তা সম্পূর্ণই স্বৈরতন্ত্রের শামিল এবং দেশের মানুষের সঙ্গে ঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়। 


দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন ও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং প্রতিটি দলই রাষ্ট্র স্বীকৃত।সেই সুবাদে, নিবন্ধিত প্রতিটি রাজনৈতিক দলই মর্যাদাপূর্ণ।প্রতিটি দলের মধ্যে একটি সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকবে, তা জনগণের কল্যাণ সাধনকে কেন্দ্র করে। এই প্রতিযোগিতায় যারা এগিয়ে থাকবে জনগণ তাদেরকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেছে নেবে তাদের পরিচালনার জন্য।এটাই রাজনীতির সুস্থ ধারা।অন্যদিকে যারা, সুস্থ ধারাকে দূরে ঠেলে খুন,জখম ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস ও ভোট চুরির মত অনিয়মের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় বা ক্ষমতায় যেতে চায় তারা এক কথায় দেশ ও জনগণের শত্রু, তাদেরকে প্রতিহত করা আপামর জনগণের নৈতিক দায়িত্ব নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। 


বাংলাদেশে সামনে সংসদ নির্বাচন, যার মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে দেশের কোন একটি রাজনৈতিক দল বা জোট । সামনের নির্বাচন কিভাবে করতে হবে , কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হলে জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে তা দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এক টেবিলের  আলোচনার বিষয়বস্তু। এই বিষয়টি যদি কোন একক দল বা শক্তির সিদ্ধান্তে হয় তবে  সেখানে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।যদি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক টেবিলে বসানো না যায় তবে সংঘাত এড়াতে ভিন্ন পথে সুষ্ঠু সমাধান খুঁজতে হবে। 

বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বৃহৎ এক অংশের দাবী একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের।যে প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতীতে সাধারণ মানুষের  কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে।যা বর্তমান সরকার ২০১১ সালে এই  তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে  বিলুপ্ত ঘোষণা করে। 

আমি মনে করি, কাগজে কালির হরফে লেখা সংবিধানের কথা যেমন দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সংরক্ষন ও পালন যেমন সরকারের মহান দায়িত্ব , আবার সময়ের প্রয়োজনে ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দাবীর প্রেক্ষিতে সংবিধান পরিবর্তন ও পরিমার্জন করাও কখনো কখনো অপরিহার্য কর্তব্য। কারণ, জনগণের জন্যই দেশ ও দেশের সরকার ব্যবস্থা।  


বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়ার মতে এক হতে পারছে না সেহেতু কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে তার দায়িত্ব জনগণের উপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। সেই প্রেক্ষাপটে সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সরকার অনলাইন প্লাটফর্ম বা অন্য কোন মাধ্যমে একটি ভোটের আয়োজন করতে পারে, যে ভোটে দুটি অপশন থাকবে, এক। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, দুই। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দুইটি অপশন থেকে ভোটার একটি অপশন বেছে নিয়ে তার ভোটের মাধ্যমে মত প্রদান করবেন। দিন শেষে যে অপশনে জনগণের চাওয়ার আধিক্য অর্থাৎ ভোট বেশী পড়বে সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি বর্তমান সরকার সামনের সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে  তবেই বর্তমান সরকারকে জনগণের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিগণিত করা হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় রক্তপাতহীন একটি নির্বাচন ও সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে।  


নিজের ঘরের সমস্যা সমাধানে তৃতীয় শক্তির দ্বারস্থ হলে অধিকাংশ সময়ে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ সাধনের সম্ভাবনাই বেশী থাকে। দেখা যায়, তৃতীয় শক্তি অন্যের দুর্বলতার সুযোগে নিজ স্বার্থ হাসিল করে ঘর ধ্বংস করে বেরিয়ে যায়, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নিজের ঘরে যদি মতানৈক্য সৃষ্টি হয় তবে কমবেশি ছাড় দিয়ে ঐকমত্যে এসে ঘর রক্ষার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকাই কল্যাণকর। নতুবা,যেদিন গোঁয়ারতুমি করে যাদের পরামর্শে ঘরহারা হবেন ঐদিন দেখবেন আপনার বুদ্ধিদাতা বন্ধুর ঘরে আপনার আর জায়গা হচ্ছেনা, জায়গা হবে রাস্তার খোলা আকাশের নিচে।নিজের ঘর সুন্দর থাকলেই অন্যের ঘরে অতিথির মর্যাদার পাওয়া যায়,আর নিজের ঘর না থাকলে অন্যের ঘরে আশ্রিত হতে হয়। এটাই পৃথিবীর বাস্তব নিয়ম।ঘর হারিয়ে সুবুদ্ধির উদয় হলে কোন লাভ নেই,বরং নিজের জীর্ণ ঘরে বসে ঘরের মানুষদের নিয়ে ঘরকে কিভাবে আরও মজবুদ করা যায় সেই ভাবনাই বুদ্ধিমানের কাজ। পৃথিবীর অনেক প্রতিষ্ঠিত দেশ আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট ও রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে।যা থেকে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।  


অর্থাৎ, নিজের দেশের সমস্যা সমাধানে নিজ দেশের রাজনৈতিক দল ও জনগণের উপর আস্থা রাখুন।ইউরোপ, আমেরিকা,ভারতকে বন্ধু না বানিয়ে নিজের দেশের রাজনৈতিক দল ও জনগণকে বন্ধু বানান। তা, আপনার দলের  জন্য যেমন কল্যাণকর তেমনি দেশের প্রতিটি মানুষের জন্যও স্বস্তির বিষয় ।


মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)

প্যারিস,ফ্রান্স ।

শনিবার, ২৪ জুন, ২০২৩

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (শেষ পর্ব - পাছি প্লেন জু )

২৪ ডিসেম্বর ২০২১, আমাদের ঘরে ফেরার দিন। ট্রেন সন্ধ্যা সাতটায়। এয়ারবিএনবি’র Airbnb শর্ত অনুযায়ী সকাল এগারটার মধ্যে আমাদেরকে ঘর ছেড়ে দিতে হবে।সমস্ত দিন হাতে থাকলেও কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নেই ।কয়েকদিন সবার মধ্যে যে ছোটার তাড়া ছিল তা ভেতর থেকে চলে গিয়ে অবসাদ ভর করেছে।সকালে সবার ঘুম ভেঙ্গেছে আয়েশি ভঙ্গিতে। নাস্তা সেরে সবার ব্যাগ গোছানোর পর্বও শেষ হয়ে গেল।ট্রেন ছাড়বে দিনের শেষে তাই এতোগুলো বড় ব্যাগ সঙ্গে করে বাইরে অবস্থান করা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাসার মালিককে বাসা ছাড়ার আগে ফোন করে অনুরোধ করে বললাম, আমাদের ট্রেন সন্ধ্যায় তাই ভারি ব্যাগগুলো যদি কোথাও রাখার ব্যবস্থা করে দিতেন তবে মাঝের এই দীর্ঘ সময় আমাদের ঘোরাফেরার জন্য একটু সহজ হত।ভদ্রলোক উত্তরে বলল, আজ বাসায় কোন অতিথি উঠবেনা, চাইলে সারাদিন আপনারা বাসা ব্যবহার করতে পারেন।ভদ্রলোকের কথায় মনে হল, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেলাম। দিনের সারাটা সময় আমাদের জন্য ঝরঝরে হয়ে গেল।আলো ঝলমলে এবং কুয়াশামুক্ত সকাল,জানালায় চোখ রাখতে দেখি সুদূরে পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়াগুলো জেগে উঠে উঠেছে। ঐ দিনের সকালে পাহাড় যে ভাবে দৃশ্যমান হয়েছে অন্যদিনগুলোতে সে ভাবে দেখা হয়নি।অধিকাংশ সময় পাহাড়ের উপরিভাগ মেঘ ও কুয়াশায় ডাকা থাকায় চূড়াগুলো দেখা যায়না। মাঝে মাঝে মেঘ সরে গেলে বা  কুয়াশা কেটে কিছু সময়ের জন্য চূড়ারগুলোর কিছু কিছু অংশ ভেসে ওঠে। ওদিন ছিল ব্যতিক্রম,চারপাশের সমস্ত পাহাড় চূড়াগুলো যেন একযোগে সমস্ত আবরণ ঝেড়ে ফেলে শরীরের সমস্ত রূপ মেলে ধরেছিল। দিনটি এমন, বেলকনিতে বসে পাহাড়ের এমন দৃশ্যকে সামনে রেখে কফির চুমুকে গল্প করে কাটিয়ে দেয়ার।কিন্তু মনে হল, দিনটি যেহেতু নিজের মত করে পাওয়া গেল তাই বাসে করে নতুন  কোন জায়গায় গেলে মন্দ হয় না।ওরা দুজন জানিয়ে দিয়েছে, সারা দিন বাসায় কাটিয়ে একবারে ফিরতি ট্রেনে উঠবে।তাই একাই বেরিয়ে পরলাম Auvergne-Rhône-Alpes নতুন কোন অঞ্চল আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে।  

ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে বাস স্টেশনে একটি বাস যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ।চালককে বললাম,আমি প্যারিস থেকে কয়েকদিনের জন্য এই অঞ্চলে ঘুরতে এসেছি,দুদিন শামনি শহর ও এর আশেপাশের অঞ্চল ঘুরেছি,এখান থেকে বাস অন্য আর কোন পর্যটন স্থানে যায়, জানাবেন কি? ভদ্রলোক বলল, আমি পাছি প্লেন জু (Passy Plaine-Joux)যাবো,এটি একটি স্কি সেন্টার এবং খুব আকর্ষণীয় স্থান,আমি একটু পরেই রওনা হবো, আপনি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আমি কোন চিন্তা না করে চালকের কাছ থেকে ছয় ইউরোতে একটি টিকেট সংগ্রহ করে বাসের ভেতরে গিয়ে বসলাম।

 

বাস কিছু সময়ের মধ্যে সমতল উপত্যকা গ্রাম পেরিয়ে প্রবেশ করলো পাহাড়ি পথে।পাহাড়ের কোল ঘেঁষা পথ একে বেঁকে উপড়ে উঠে গেছে।পথের মাঝে মাঝেই ভয়ঙ্কর বাক। চালক খুব সতর্কতার সঙ্গে সেগুলো পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।মোটরযান চালনায় বিশেষ দক্ষতা না থাকলে এই পথে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক।রাস্তার কোথাও কোথাও ভয়ঙ্কর পাহাড়ি ঢালু কিন্তু তেমন কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী বেড়া নেই।বাস যতই উপড়ে উঠছিল দূরের পাহাড়ি গ্রাম ও বিস্তীর্ণ উপত্যকা ভূমি ছবির দৃশ্যের মত ধরা দিচ্ছিল দৃষ্টিতে।এই খাড়া পাহাড়ি পথের পাশদিয়ে কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে ছোট ছোট আবাসিক এলাকা, দোকানপাট, বিনোদন কেন্দ্র, হোটেল, রেস্তরাঁ।রাস্তার দুধারে ঘন পাইনের বন।সুশীতল বরফের ছায়াঢাকা পথ।বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে চলার পথের সময়টা উপভোগ করছিলাম আর ওদেরকে মনে পড়ছিল।প্রায় চল্লিশ মিনিটের পাহাড়ি এক দুর্গম খাড়া পথ বেয়ে বাস তার গতি থামাল পাছি প্লেন জু স্টেশনে। আমি বাস থেকে নেমেই আশেপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করে নিলাম।    

 

উপত্যকা ভূমি থেকে ১৩৬০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ছোট্ট একটি স্কি ষ্টেশন।পর্যটক ও স্কিয়ারদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি দারুণ স্থান।রেস্তরাঁ,পর্যটন তথ্য কেন্দ্র,জাদুঘর,স্কি শেখার স্কুল এবং স্কি ভাড়া ও বিক্রয় সামগ্রীর দোকান সবই রয়েছে।স্থানটির একপাশে ৩৮২ মিটার উচ্চতার পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা এবং চূড়া ধূসর মেঘের সঙ্গে জড়াজড়ি করছিল। অন্য পাশে  উন্মুক্ত আকাশের নিচে উপত্যকা ভূমি আর আদিগন্ত পর্বতমালা। মেঘ আর রৌদ্রের লুকোচুরি খেলায় প্রতিনিয়ত অদ্ভুতভাবে পর্বতচূড়াগুলোর রূপ পরিবর্তন হচ্ছে।আমি বরফের স্তরের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালাম পাহাড়ের পারের উপর।পারের জায়গায় জায়গায় সতর্ক সংকেত দেয়া রয়েছে।পার এতোটাই খাড়া এবং উঁচু যে কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।বিমান থেকে যে ভাবে ভূমি দেখা যায় এখানে দাঁড়িয়ে সামনের দৃশ্যপট সেভাবে ধরা দিলো আমার সামনে।কয়েক দিনের অতি পরিচিত এলাকাকে এক পৃষ্ঠায় অঙ্কিত একটি মানচিত্রের মত লাগছিল। সুউচ্চ স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো ২২৭৫ মিটারের দীর্ঘ সেতুর ভিয়াদুক দে এগ্রাত (Viaduc des Égratz), যেটির উপর দিয়ে আমরা বাসে করে শামনি গিয়েছিলাম সেটি একেবেঁকে চলা একটি চিকন সরীসৃপের মত দেখাচ্ছিল।ক্যামেরার লেন্স জুম করে খুঁজে পেলাম ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে  (St-Gervais-les-Bains-le-Fayet)ট্রেন স্টেশন এবং আমাদের ক্ষণিকের আবাস এলাকা। বুঝতে পারলাম আমি কোথায় অবস্থান করছি। কয়েকদিন ছা-জারভে লে বাঁ এলাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি পাহাড়ের বিশালতার দিকে দাঁড়িয়ে মনের ভেতর নানা প্রশ্ন জাগছিল,ঐ উচ্চতায় উপর কি মানুষ যেতে পারে?ঐপাহাড়ের ভাজে কি কোন বসতি আছে? ইত্যাদি। দূর থেকে খাড়া পাহাড়টির অবয়ব দেখলে এতোই দুর্ভেদ্য মনে হয় যে, যে কারো মনে এমন ভাবনার জন্ম দেবে।

পাছি প্লেন জু’র পারে দাঁড়িয়ে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম।দূর থেকে যে পাহাড় দেখে আমার মধ্যে নানা কৌতূহল জন্ম নিয়েছিল আমি বাসে করে সেই পাহাড়ের গা বেয়ে তারই শীর্ষ  চূড়ায় এসে পৌঁছেছি।ব্যাপারটা যে এভাবে বাস্তব হবে তা ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম।

পাছি জু’র পারে দাঁড়িয়ে Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কে একটি ধারনা পেলাম।খালি চোখে সমস্ত অঞ্চলকে একটি পেন্সিলে আঁকা ধূসর রঙয়ের স্কেচের মত লাগছিল।ক্যামেরার লেন্স জুম করে ধরার চেষ্টা করছিলাম দূর পাহাড়ি অঞ্চলের জীবন চিত্র। বিস্তীর্ণ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উপত্যকা ভূমি। তার মাঝে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম, আবার কোথাও পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিচ্ছিন্ন মানব বসতি ঘরবাড়ী।



মেসেঞ্জারের ভিডিও কলের মাধ্যমে সুমিকে আমার অবস্থান দেখিয়ে বললাম, দুপুরের খাবার সেরে যদি আসতে পারো তবে আল্পসকে আরও নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবে। চারপাশের দৃশ্য দেখাতেই ও সহজেই রাজী হয়ে গেল। আমি ওদেরকে এখানে আসার বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে আবার আল্পস উপভোগে নিমগ্ন হলাম। 


 


পাছি’র ছোট্ট পর্বত পৃষ্ঠ যেন একটি বিনোদন কেন্দ্র।খ্রিস্টমাস উপলক্ষে নানা আয়োজনে মেলার ইমেজ বিরাজ করছিলো।বাচ্চাদের আনন্দ দেবার জন্য অনেকে পের নোয়েল বা স্যান্টাক্লজ সেজে এসেছে, কেউবা ধর্মীয় রূপকথার নানা চরিত্রের পোশাক পরে বা বাচ্চাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।

কুকুরের স্লেজ গাড়ি কিভাবে ছুটে চলতো পাহাড়ি বরফ ঢাকা পথে তা সিনেমার পর্দায় দেখেছি, কিন্তু এবার সেই ঐতিহ্যবাহী স্লেজ গাড়ীর দর্শন মিলল এখানে।শেয়াল সদৃশ এক দল সুদর্শন  কুকুর পর্যটকদের পেছনে বসিয়ে টেনে চলছিলো বরফের উপর দিয়ে।



পাহাড়ের নানা রূপ ক্যামেরায় ধারণ করতে করতে ছোট্ট যন্ত্রটি দুর্বল হয়ে পরল তাই ওকে চার্জ দেবার জন্য একটি ক্যাফে বারে ঢুকলাম।কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাফে বারের বৈদ্যুতিক হিটারের উষ্ণতায় শরীরে বেশ চনমনে ভাব ফিরে এলো।ক্যাফের চুমুকে নিজে সতেজ হওয়ার পাশাপাশি ছবি তোলার যন্ত্রটি বৈদ্যুতিক সংযোগে কিছুটা  শক্তি সঞ্চার করে নিলো।সুমি ফোনে জানালো, ওরা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে।   

বিকেল সাড়ে তিনটের দিকে আমার জন্য একটি পিজার বক্স হাতে করে পাছি পৃষ্টে এসে নামলো। চারপাশের দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই উৎফুল্ল ভাব ফুটে উঠল সুমির মধ্যে।আল্পস ভ্রমণে পাছি দর্শন সুমি ও মিশেলের কাছে বাড়তি পাওয়া।  ওদের পরিকল্পনার বাইরে এমন একটি জায়গায় আসতে পেরে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানালো।হাতে সময় কম থাকায় ওরা নেমে পরল পাছি’র সৌন্দর্য উপভোগে আর আমি ক্ষুধা নিবারণের স্বার্থে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পিজা অনেকটা জোর করেই পেটে ঢোকাতে লাগলাম পাছি’র এককোণে পেতে রাখা অবকাশ চেয়ার বসে।      


ওরা আসাতে আমার আল্পস ভ্রমণের শেষ সময়টুকু বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল।স্মৃতি ধরে রাখতে নিজেদের একে ওপরের  ছবি তুলে কাটল বেশ কিছু সময়।সবাই একসাথে হেঁটে বেড়ালাম পাছি পৃষ্ঠের বরফ ভূমির উপর দিয়ে।  



যেহেতু,আমাদের প্যারিস ফেরার ট্রেনের সময় সাতটায় তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কিছুটা সময় হাতে রেখে বিকেল পাঁচটার বাস ধরার প্রস্তুতি নিয়ে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালাম।বাস আসার নির্ধারিত সময় অতিক্রম হলেও স্টপেজে বাসের দেখা মিলল না।প্রায় পনের মিনিট পার হয়ে গেল।কিছুটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে পাছি’র প্রবেশ পথের দিকে বাসের জন্য আমরা অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।ফ্রান্সে পাবলিক যানবাহনগুলো সাধারণত সময় সূচি মেপে চলাচল করে, তবে কোন কারণে ট্রাফিক সমস্যার সৃষ্টি হলে ট্রান্সপোর্টগুলোর সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। বুঝতে পারলাম আমরা তেমনি সমস্যার কবলে পরেছি।প্রতিটি অতিতিক্ত মিনিট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হতে লাগলো।নির্ধারিত সময়ের প্রায় চল্লিশ মিনিট পর পাছি’র প্রবেশদ্বারে বাসের আগমন ঘটল।স্টেশনে যাত্রী তোলার জন্য বাস আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে  ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে’র উদ্দেশ্যে রওনা করলো।আমরা অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রওনা করলাম।সময়টা এমন যে পথের মধ্যে কোনও প্রকার ট্রাফিক সমস্যায় সময় ক্ষেপণ হলেই আমাদের ট্রেন মিস হবে। পাহাড়ের ঢালু পথে ঘুরে ঘুরে বাস নামতে লাগলো।বাস নিচ থেকে থেকে যখন উপড়ে উঠছিল তখনকার পাহার দেখার অনুভূতি থেকে নামার অনুভূতি সম্পূর্ণই ভিন্ন লাগছিল। আসার সময় নিশ্চুপ ভাবে সময় কাটলেও যাবার বেলার গল্প গুজব আমাদের আল্পস ভ্রমণের স্মৃতিটাকে রাঙ্গিয়ে তুলল।যা অপরিকল্পিত ভাবে হয়ে গেল।বাস দুই একটি স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলা ছাড়া সময় ক্ষেপণ না করে এগিয়ে যেতে লাগলো।সন্ধ্যার জনমানবহীন পাহাড়ি পথটা এমন, যদি কেউ পথের মধ্যে কোন কারণে শেষ বাস মিস করে তবে তার জন্য মহাবিপদ।গা ঝমঝমে পাহাড়ি সড়কটিতে কোন পথচারী হাঁটার ফুটপাত নেই।এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজের দূরত্বও অনেক।পাহাড়ের কোল ঘেঁষা সড়কটি এতোই খাড়া যে এই পথ ধরে হেঁটে ওঠা এবং নামা দুটোই কষ্টকর এবং বিপদজনক। তাই হয়তো কর্তৃপক্ষ পথচারী চলাচলের ব্যবস্থা রাখেনি।মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে স্থানীয়দের যে দু চারতে বসতি রয়েছে তাদের এক মাত্র চলাচলের মাধ্যম ব্যক্তিগত মটরগাড়ি। পর্যটকরাই মূলত পাছি পৃষ্ঠে ওঠা ও আশেপাশের অন্যান্য পর্যটন স্থানে যাওয়ার  জন্য পাবলিক বাস ব্যবহার করে থাকে।দুচার দিন ঘোরার জন্য এমন এলাকা আকর্ষণীয় হলেও যাদের এসব অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে হয় তাদের যে নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সন্ধি করে দৈনন্দিন জীবন কাটাতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও ফ্রান্সের নাগরিক জীবনে আধুনির সুযোগ সুবিধার সবকিছুই প্রত্যন্ত রয়েছে।যা হোক,বাস প্রায় চল্লিশ মিনিটের সতর্ক যাত্রার ইতি টানল ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে স্টেশনে।আমরা প্যারিস ফেরার ট্রেনে উঠতে হাতে ত্রিশ মিনিট পেলাম।বাক্সপ্যাঁটরা গোছানোই রয়েছে।দ্রুত পায়ে হেঁটে বাসায় পৌছুলাম।যার যার ব্যাগ নিজ দায়িত্বে নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমাদের ক্ষণিকের ছোট্ট নীড় থেকে।দরজার পাশের ছোট্ট একটি বাক্স। বাসার চাবিটি বক্সের মধ্যে ফেলে দেয়ার মধ্যদিয়ে শেষ হল আমাদের আল্পসের গায়ে ছুটে চলার দিন কয়েকের গল্প ।



মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)

পারিস ,ফ্রান্স । 

সোমবার, ৫ জুন, ২০২৩

মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতিকে সুখে রাখার মধ্যে নিহিত অন্তরের প্রকৃত সুখ

কারো অপরাধ বা পাপের মাত্রা বেশী হয়ে গেলে সে নিজেই নিজের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাকে নিয়ে কেউ কিছু না ভাবলেও সে  ভাবতে শুরু করে, তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো বুঝি প্রতিশোধ নেবার জন্য ভেতরে ভেতরে কৌশল আঁটছে ।ফলে,নিজ সৃষ্ট শঙ্কিত ভয়ে  নিজেই তাড়িত হতে থাকে,কখনো নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিতে ভোগে।এ ভাবেই অপরাধের শাস্তি স্বরূপ নিজের ভেতরে বিক্ষুব্ধ  হয়ে একসময় জীবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে ।


একবার এক তত্ত্বজ্ঞানীকে( মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জুয়েল) প্রশ্ন করেছিলাম, ভালো থাকার সহজ উপায় কি? এক কথার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ভালো থাকার সহজ উপায় «  অন্যকে ভালো রাখা » 


কেউ যখন কাউকে ক্ষতি করে সেই ক্ষতির পরিমাণ দৃশ্যমান এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাময়িক কষ্ট পেয়ে সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠে।কিন্তু, যে ক্ষতি করে সে ক্ষতিগ্রস্তের চেয়ে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায়, যা অদৃশ্যমান।অদৃশ্যমান এই ক্ষতির ভয়াবহতা থেকে সহজেই সে বেরুতে পারে না। 


অর্থাৎ, কাউকে ক্ষতি করে কখনো লাভবান হওয়ার যায় না, বরং নিজেকেই বড় ক্ষতির মধ্যে ফেলা হয় । 


যে মানুষ যত বেশী মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতিকে সুখে রাখার সংগ্রামে নিজেকে নিমগ্ন করে সেই মানুষের অন্তরের পবিত্রতা ও সুখ অনুভূতি ততই বাড়তে থাকে। 

সোমবার, ২২ মে, ২০২৩

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-৪ শামনি গ্রাম)


২৩ ডিসেম্বর ২০২১,আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় দিনটি ছিল ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী দেশ সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহর পরিদর্শন। ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে  St-Gervais-les-Bains-le-Fayet থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের শহর। ট্রেনে করে পৌনে দুই ঘণ্টার যাত্রা পথ।২২ ডিসেম্বর, শামনি থেকে বাসায় ফিরে আমাদের সিদ্ধান্ত অটুট থাকলেও সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘুম থেকে উঠে সুমি ও মিশেলকে জাগানোর চেষ্টা করতেই ঘুম চোখে সুমি জবাব দিলো, আমি জেনেভা যাবো না, শরীর বেশ ক্লান্ত ,আমাকে আরও ঘুমোতে হবে।ওর কথায় মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি আগে থেকেই আশা করে ছিলাম যে এই ভ্রমণের ভেতর দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশটিতে একটু পদচিহ্ন রেখে আসবো।আর এখান থেকে অল্প খরচে দিনে দিনে ঘুরে আসা একটা সুযোগও বটে।সুমির কথায় বুঝলাম ও সিদ্ধান্তে অটুট।তাই ওকে বিরক্ত না করে বললাম,তাহলে আমি একাই জেনেভা যাবো, তুমি মিশেলকে নিয়ে আশেপাশের কোন শহর থেকে ঘুরে এসো।সে অনুযায়ী ওদেরকে রেখে দিনের ভ্রমণ প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম।  


ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে স্টেশনে গিয়ে প্রথমেই দিনে দিনে জেনেভা শহরের যাওয়া ও ফিরে আসার ট্রেনের সময় সূচী জেনে নিলাম।কিন্তু ঐ মুহূর্তে একটু অংক করে  মনে হল, জেনেভা থেকে দিনের শেষ যে ট্রেনটি ফিরবে সেই ট্রেন ধরলে আমি ঐ শহরে মাত্র দু ঘণ্টার মত অবস্থান করতে পারবো। এমতাবস্থায় জেনেভা গেলেও কোথাও ঘোরার সুযোগ নাই। কারণ, নতুন শহরে কোন কিছু খুঁজে বের করতে বা কাউকে কোন তথ্য জিজ্ঞেস করতে করতেই দু ঘণ্টা সময় চলে যাবে।তাই জেনেভা যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ট্রেনের টিকেট কাটলাম  Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের একটি পর্যটন শহর  আনেছি « Annecy » যাওয়ার। ট্রেন ছাড়তে প্রায় ত্রিশ মিনিট বাকি।টিকেট হাতে স্টেশনের অপেক্ষমাণ কক্ষে বসে আছি।আবারও এক দোদুল্যমান ভাবনা ভর করলো মনের মধ্যে।ভাবছি, এক সাথে ঘুরতে এসে ওদেরকে রেখে যাওয়া কি ভালো হচ্ছে ? 

কোন নতুন  জায়গায়  গেলে অচেনা অঞ্চল আবিষ্কারের নেশা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।আমার উদ্দাম ও গতির সঙ্গে ওরা তাল মেলাতে পারে না।ওদের বৈশিষ্ট্য হল, একটা জায়গায় গিয়ে ধিরস্থির ভাবে ঘুরবে,রেস্তরাঁয় বসে জলখাবার খাবে, আয়েশি শরীরে আবার বাসায় ফিরে আসবে।আমাদের তিন সদস্যের ভ্রমণ দল রুচি ও চলার বৈশিষ্ট্যগত কারণে দুই ভাগে বিভক্ত। তাই আমাদের পরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রায়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না ।   


মনে হল,যেহেতু জেনেভা যাওয়া হচ্ছেনা তাই একা একা আনেছি « Annecy »  যাওয়ার চেয়ে ওদেরকে নিয়ে বরং একসাথে আশেপাশের একটা শহরে গিয়ে ঘুরেফিরে দিনটা কাটিয়ে দিলেই ভালো হবে।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবার টিকেট কাউন্টারে গিয়ে এক ইউরো ক্ষতিপূরণে আনেছি যাওয়ার টিকেট ফেরত দিলাম।নিজের মধ্যে এতক্ষণ কোথাও যাওয়া নিয়ে যে অস্থিরতা কাজ করছিল তা থেকে স্বস্তি অনুভব হলে লাগলো।সুমিকে ফোন করে বললাম,আমি একা কোথাও যাচ্ছিনা,তোমরা তৈরি হয়ে ট্রেন স্টেশনে চলে এসো,তিনজন একসাথে কোথাও ঘুরতে যাবো। 


ওরা শরীরের ক্লান্তি কাটিয়ে ছুটির দিনের মত হেলাফেলা করে দিনের মধ্যাহ্নে ট্রেন ষ্টেশনে এলো।সিদ্ধান্ত নিলাম বাসে করে পাহাড়ি অঞ্চলটা দেখতে দেখতে কোন একটা শহর বা গ্রামে নেমে যাবো,দুপুরের খাবার সেখানকার একটা রেস্তরাঁয় খাবো,এরপর সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। 


ষ্টেশনের পাশেই বাস ষ্টেশন।এখান থেকে কয়েকটি বাস Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের দূরবর্তী বিভিন্ন শহরের দিকে যায়।একজন বাস চালক যাত্রীর অপেক্ষায় নিজের আসনে বসে যাত্রা অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।বাস যাত্রীশূন্য।আমি চালকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাস কোথায় যাবে? ভদ্রলোক জানালো, শামনি সন্ত ভিল।ঐ মুহূর্তে স্টেশনে এই বাস ছাড়া আর কোন বাস চোখে পরল না।গতকাল আমরা শামনি থেকে ঘুরে এসেছি ,তাই একই জায়গায় দুবার যাওয়ার ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই।সুমিকে বিষয়টি জানালাম।ও বলল, যদি অন্য শহরে যাওয়ার বাস না থাকে তবে সময় নষ্ট না করে আবার শামনি’র দিকে যাওয়া যেতে পারে। যাহোক, অনেকটা উপায়ন্ত না পেয়ে এই বাসেই উঠে বসতে হল। বিশাল বড় বাসে যাত্রী শুধু আমরা তিনজন।কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চেনা শহরের দিকে পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম।বাস পাহাড়ি কোল ঘেঁষা পথ ধরে কিছুটা যাওয়ার পর মনে হল,দিনটা  একেবারে নষ্ট হবে না।এভাবে প্রায় দশ মিনিটের পথ অতিক্রমের পর বাস প্রবেশ করলো পাহাড়ি উপত্যকা ভূমিতে।রাস্তার দুপাশে ঘন গাছপালা ঘেরা গ্রামীর বাড়িঘর কিন্তু কোন প্রাণের আনাগোনা নেই।গতদিন ট্রেন থেকে যেভাবে এই গ্রামীণ জনপদকে দেখেছি সেই একই গ্রামের দৃশ্য ভিন্ন রূপে ধরা দিতে লাগলো।আমি বাস চালকে প্রশ্ন করলাম, আমরা যদি পরের স্টপেজে নেমে যাই তবে শামনি যেতে আবার টিকেট কিনতে হবে কি?  চালক জানালো,আজের দিনের যে কোন সময় একই টিকেটে আমরা বাসে করে শামনি যেতে পারবো, এজন্য আর টিকেট কিনতে হবে না।চালকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সুমির সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের স্টপেজে নেমে আশেপাশের অঞ্চল হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখব,এরপর পরবর্তী কোন বাসে করে আবার শামনির উদ্দেশ্যে রওনা করবো।যখন দ্রুত গতিতে বাস চলছিল, তখন চারপাশের স্বর্গীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিলো যদি এখনি বাস থেকে নেমে এই এলাকাগুলো হেঁটে দেখতে পারতাম তবে মনের প্রশান্তি মিলত।বাস কিছুক্ষণ পর একটা স্টপেজে থেমে একজন যাত্রী তুলে নিলো কিন্তু আমাদের সেখানে নামা হল না। সুমি বলল, আরও দূরের স্টপেজে নামবে।এতে আমার আপসোস আরও বাড়তে লাগলো। বাস চলার সময় আরও মনোরম প্রকৃতি পারি দিয়ে আমরা এগুতে লাগলাম।পরের স্টপেজে বাস থামতেই আমরা নেমে পরলাম।নিস্তব্ধ বরফে ঢাকা হিমশীতল গ্রাম।আমরা একটি গ্রামীণ রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। স্থানীয়দের বৈচিত্র্যময় স্থাপত্য নক্সার ছোট ছোট বাড়ীঘর।বাড়ীর সানসেটগুলোতে দীর্ঘদিনের তুষারের আবরণ লম্বা কাঠির মত হয়ে ঝুলে আছে। দূর থেকে  জমাটবদ্ধ তুষারের এই কাঠি দেখে যে কারো মনে হবে যে বাড়ীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ক্রিস্টাল গ্লাস দিয়ে সানসেটগুলোকে এমন নক্সা করা হয়েছে। বরফের কাঠিগুলোর উপর সূর্যের আলো পড়ায়  ঝিকমিক করছে।এগুলো ধরে দেখার কৌতূহল নিয়ে আমি একটি বাড়ীর সানসেটের কাছে গেলাম।ধরে মনে হল,এগুলো তুষার জমা বরফ হলেও দৃঢ়টা কাঁচের মত।অসাবধানতার সহিত ভাঙতে গেলে হাত কেটে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। 



আমরা গ্রামের সুশৃঙ্খল পথ ধরে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম, ছবি তুললাম তার পর আবার ফিরে এলাম বাস স্টপেজে।স্টপেজের ডিজিটাল টাইম বোর্ডের সময়সূচি অনুযায়ী বাস আসতে আরও পনের মিনিট বাকি।বয়ে চলা সোমা নেপোলিয়(রাস্তা নেপলিয়ান)পাশে একটি দৃষ্টিনন্দন হোটেল।নাম দেগুই দু মিদি (dAiguille du Midi Hôtel)।চার তলা হোটেলটি দেখতে আমাদের দেশের কুঁড়েঘরের মত। হোটেলটির আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে আমাদের অপেক্ষার সময় পার হল। 

বাস আসতেই আমরা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবার বাসে উঠলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, যদি সারাটা দিন ইচ্ছে মত এই ভূস্বর্গের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছবি তুলে কাটিয়ে দিতে পারতাম তবে পরিপূর্ণ ভ্রমণ তৃপ্তি মিলত।চারপাশে যে দিকেই তাকাই সেদিকটাই যেন শিল্পীর আঁকা ছবির মত।চাইলেইতো আমি ওদেরকে রেখে সেটা করতে পারবোনা ,তাই অলীক ভাবনাকে মনের মধ্যে চাপা দিয়ে গল্প কথায় বাসের জানালা দিয়ে একসাথে প্রকৃতি উপভোগে মেতে উঠলাম।


শামনি শহর যেহেতু ওদের চেনা তাই সুমিকে বললাম, আমি সন্ত ভিলের (সিটি সেন্টার)আগের স্টপেজে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করে পরে শামমিতে আসতে চাই,তোমাদের যেতে কোন অসুবিধা হবে নাতো।ও আশ্বস্ত করে জানালো ওরা একা যেতে পারবে।ওর সম্মতিতে আমি শামনি’র এক স্টপেজ আগেই ওদেরকে বাসে রেখে নেমে পরলাম।বেশ ঘনবসতি আবাসিক এলাকা।বয়ে চলা লারভ  lArve নদীর দুপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে এসব বশত বাড়ী।একটু দূরে হোটেল,রেস্টুরেন্ট ও শপিং সেন্টারে মানুষের কোলাহল কিছুটা শহুরে ইমেজ সৃষ্টি করেছে।গ্রামটির নাম এগুই দু মিদি (dAiguille du Midi) ।


কিছুক্ষণ পর সুমি ফোন করে জানালো, ওরা শামনি পৌঁছে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাঘুরি করছে।ওর কথায় অনেকটা স্বস্তি নিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক এই গ্রামে নিজের মত ঘুরে ফিরে সময় কাটালাম। শামনি সন্ত ভিলে পৌঁছে ওদেরকে খুঁজে পেতে খুব বেশী বেগ পোহাতে হল না শহরটা চেনা থাকার কারণে।একসাথে মিলিত হয়ে আমরা প্রথমেই একটি ফরাসি রেস্তরাঁয় ঢুকে শামনির ঐতিহ্যবাহী পিজা ও কোকাকোলা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। 


চারপাশের পাহাড়ের চূড়া ছুঁইছুঁই সাদা মেঘের বিচরণ,তার উপর সূর্যের তির্যক আলোর রশ্মি পরে অদ্ভুত সুন্দর এক আবহ তৈরি করেছে।এমন একটি আলো ঝলমল পড়ন্ত দুপুর আমরা শহরে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে উপভোগ করলাম।এরপর চেনা শহরে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি।আমি ওদের সাথে  হাঁটলেও আমার মন পরে আছে বাসের মধ্যে থেকে দেখা বয়ে চলা লারভ  lArve নদীর দুপাশের পাহাড় আর বনভূমির সম্মিলনে সৃষ্টি অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে।আসার সময় আপসোস হচ্ছিলো, যদি এই দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করতে পারতাম।মনে মনে ভাবছি,শহর থেকে বেরিয়ে ওদেরকে নিয়ে গ্রামে দিকে গিয়ে দিনের শেষ সময়টুকু কাটানোর কথা। কিন্তু,আমি জানতাম ঐ মুহূর্তে ওদেরকে এমন প্রস্তাব দিলে রাজি হত না। কারণ,গন্তব্যহীন  হাঁটাহাঁটি ওদের পছন্দ না।  


সুমিকে বললাম,আমি যদি ছবি তোলার জন্য এগুই দু মিদি গ্রামের দিকে যাই তবে তোমরা কি নিজের মত করে ঘুরেফিরে আমাকে ছাড়া বাসায় ফিরতে পারবে? ও বলল, পারবে। ওর আশ্বস্তায় আর দেরি না করে ওদের থেকে বিদায় নিলাম।সন্ত ভিল থেকে বাসে করে রওনা করলাম গন্তব্যহীন শামনি'র গ্রামীণ এলাকার দিকে।প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পারি দেয়ার পর একটি স্টপেজে নেমে পরলাম।খুবই নির্জন স্থান।পাহাড়ি উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা লারভ  lArve নদী এক পাশে বয়ে গেছে মহাসড়ক, অন্যপাশে রেল লাইন,আর বরফের আবরণে ঢাকা গাছপালার মধ্যে নয়নাভিরাম ছোট ছোট বাড়িঘর।আমি প্রায় ত্রিশ মিনিট মহাসড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলাম।এমন এক রাস্তা দিয়ে আমি হাঁটছিলাম যে হঠাৎ কোন প্রকার বিপদের কবলে পরলে কারো সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়।এই সময়ের মধ্যে আমার সামনে দিয়ে পার হয়েছে দু তিনটি মটরগাড়ি আর স্থানীয় দুই একজন মানুষ।মানুষের নির্বাসন জীবনের অনুভূতি কেমন হতে পারে তা ওই সময়টুকুর মধ্যে কিছুটা হলেও আমি উপলব্ধি করেছি। বাসের সময় সূচি না জানা থাকায়  কিছুটা শঙ্কা হচ্ছিলো,সন্ধ্যায় শামনি শহরে ফেরার বাস পাবো কিনা।রাতের অন্ধকার নেমে আসলে জনমানবহীন এমন পাহাড়ি এলাকায় একা একা হাঁটা যে কোন নতুন মানুষের জন্য ভয়ের ব্যাপার।চারপাশের অপার সৌন্দর্য আর ছবি তোলার নেশার কাছে মনের মধ্যে জেগে বসা শঙ্কার কালো মেঘ ঘনীভূত হতে পারছিলো না। আমি দুর্দম গতি হাঁটতে হাঁটতে দিনের একেবারে পড়ন্ত বেলায় এমন এক অদ্ভুত জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, যে জায়গার দৃশ্যপট শুধু কল্পনা করা যায়, বাস্তবে প্রত্যাশা করা যায়না।কিন্তু, আমি সেই কল্পনার বাস্তব দৃশ্যের সামনেই স্বপ্নের মত দাঁড়িয়ে আছি তা ভেবেই শিহরিত হচ্ছিলাম।লারভ নদীর একটি সেতুর মাঝে অবস্থান নিলাম। দুই দিগন্তের দৃশ্যপট দু ভাবে ধরা দিলো আমার সামনে।একদিকে, সরু লারভ  lArve নদীর বরফ শীতল জল তির-তির করে বয়ে চলছে,নদীর দুধার সাদা বরফে আবৃত, মাঝে মাঝে কিছু জংলা গাছপালা তুষার মেখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে,সুদূরে নদীর বাঁকে ছোট্ট কুঁড়েঘর আকৃতির একটি নীড়, তার ওপারে মনে হচ্ছে দুপাশের পাহাড় যেন ধনুকের মত বেঁকে এক হয়ে গেছে।অন্যদিকে, লারভ বয়ে গেছে একটু এঁকেবেঁকে,হাঁটুজলের মাঝে কোথাও কোথাও শরীর ভাসিয়ে স্থির হয়ে আছে ছোট বড় আকৃতির পাথর খণ্ড।প্রতিটি পাথর খণ্ডের উপর সাদা বরফের আবরণ ফেলে প্রকৃতি যেন লারভ নদীর বুককে ভিন্ন রূপে অলঙ্কৃত করে তুলেছে।নদীর পারে মাঝে মাঝে গাড় খয়েরি রঙা সুশৃঙ্খল ডালপালার উপর বরফ জরিয়ে দাঁড়িয়েছে আছে পাইন গাছের দল।আল্পসে ঘেরা এমন এক  নির্জন প্রকৃতির মাঝে সমস্ত চিন্তার জাল ছিন্ন করে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।সুমিকে ফোনে বললাম,মনে হচ্ছে তোমরা বড় কিছু থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করলে।ওরা ট্রেনে করে ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে,আমি জানালাম, আরও কিছু সময় এখানে অবস্থান করে তার পর আমিও ফিরবো।


দূর পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের সোনালি আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে।বুঝলাম সূর্য অস্তাচলের পথে।তাই জনমানবহীন এলাকা ছেড়ে আবার মহাসড়ক ধরে বাস স্টেশন খুঁজতে হাঁটতে লাগলাম।কিন্তু, হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম ট্রেন স্টেশন লে পেলোরা les pélerins।ফলে, আমাকে আর শামনি শহরে ফেরার প্রয়োজন হল না। এখান থেকেই বাসায় ফেরায় উপায় হল।স্টেশনে ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে যাওয়ার ট্রেন আসতে ত্রিশ মিনিট বাকি।ধীরে ধীরে আল্পসের বুকে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগলো।বন পাহাড়ের গ্রামে জ্বলে উঠল বৈদ্যুতিক বাতি, আর দিনের আলো ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যেতে লাগলো লে পেলোরা’র চতুর্দিকের আল্পসের প্রাচীর। অচেনা রাতের গ্রাম,একলা আমি লে পেলোরা’র les pélerins প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ।এই স্টেশন পারি দিয়েই কিছুক্ষণ আগে নীড়ে ফিরেছে মিশেল আর সুমি।ওরা যদি জানতো আমি এই এলাকায় অবস্থায় করছি, তবে হয়তো আমাকে তুলে নেয়ার জন্য নেমে পরত লে পেলোরাতে, আমার জন্য অপেক্ষা করতো লে পেলোরা'র প্লাটফর্মে।




বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-১)

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-২ , মোঁ ব্লঁ)

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-৩ শামনি)

মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)

পারিস ,ফ্রান্স ।  

শনিবার, ২০ মে, ২০২৩

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-৩ শামনি)

 
২২ ডিসেম্বর ২০২১, কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলোক ছটা এসে পড়েছে বন্ধ জানালার কাঁচের উপর।ঘুম থেকে উঠেই অনুমান করে নিলাম আজকের দিনটিও রৌদ্র ঝলমলে হবে। মনে হল, দিনটি শামনি শহরে কাটালে মন্দ হয়না। 
আমাদের আল্পস ভ্রমণ সূচীর প্রধান আকর্ষণের স্থান ছিল শামনি শহর ।যাদের ভ্রমণের নেশা রয়েছে এবং ভ্রমণ সম্পর্কে জানাশোনার চেষ্টা করেন তাদের কাছে ফ্রান্সের শামনি শহর একটি স্বপ্নের নাম।  

আমার ইচ্ছের সঙ্গে সুমি ও মিশেল  সহমত পোষণ করলো। ওদের বেরুবার প্রস্তুতি নিতে বেশ সময় লাগবে। তাই ভাবলাম, ওদের প্রস্তুতির সময়টুকুর মধ্যে বাসার পাশের পার্ক থার্মাল (Parc Thermal)এ গিয়ে সকালের প্রকৃতির উপর কিছু আলোকচিত্র ধারণের চেষ্টা করা যেতে পারে।সকালের নাস্তা সেরে আমার আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম, আর সুমিকে বললাম, বাসা থেকে বেরুবার সময় আমাকে একটা কল করতে। ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে (St-Gervais-les-Bains-le-Fayet) আসার প্রথম দিন পার্ক থার্মালের প্রবেশ দরজা দেখে ভেবেছিলাম, এখানে অবস্থান কালের কোন এক সময় পার্কের ভেতরটা পরিদর্শন করতে হবে।

পার্কের ঢুকে কিছুটা পথ এগিয়ে মনে হল, তুষারে আবৃত গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ী বেষ্টনীর কারণে পার্কটির ভেতরে আলো অন্ধকারের ভৌতিক এক আবহের সৃষ্টি করেছে।পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি ক্যানাল বা নালা।নালা  মধ্যে  ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের উপর দীর্ঘদিনের জমে থাকা তুষার কঠিন বরফে রূপান্তর হয়ে মুক্তার মত চিকচিক করছে। নালাটিতে পানির প্রবাহ তেমন নেই।।পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানির ধারা পাথরের গায়ে গায়ে লেগে কল কল ধ্বনি তুলে ধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের প্রাচীর টপকে সূর্যের তির্যক রশ্মি প্রাচীন বৃক্ষ শাখা ভেদ করে এমন ভাবে পড়েছে যে মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওপার থেকে প্রোজেক্টরের আলো ফেলা হয়েছে ভূমির উপর। সবমিলিয়ে শৈল্পিক আলোকচিত্র ধারণের জন্য যেমন প্রকৃতি প্রত্যাশা করেছিলাম ঠিক তেমন আবহ পার্কটির ভেতরে বিরাজমান। ভূমির উপর দীর্ঘদিনের তুষারের জমে থাকা স্তর কংক্রিটের পাটাতনে পরিণত হয়ে আছে। তাই পার্কের ভেতরের  রাস্তা ছাড়া অন্য জায়গা দিয়ে হাঁটা বেশ বিপদজনক।তবুও ছবি তোলার নেশায়  ঝুঁকি নিয়েই পার্কের বরফের ভূমির উপর ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু পছন্দের ল্যান্ডস্কেপ তোলার কাজ সেরে ফেললাম। 

প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পার্ক, কিন্তু বাইরের প্রবেশ দ্বার দেখে তেমনটা অনুধাবন করা যায় না।মনে হল, এখানে না আসলে আল্পস ভ্রমণটা অসম্পূর্ণই  থেকে যেত। 


 

মোবাইল ফোনের স্কিনে চোখ রাখরেই দেখি,কল লিস্টে সুমির বেশ কয়েটা কল উঠে আছে। ছবি তোলার গভীর মগ্নতা আর প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য ফোনের রিংটোনের আওয়াজ কানে পৌছুতে দেয়নি। আমি ওকে দ্রুত ফোন করলাম, ও জানালো ওরা ট্রেন স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।তাই,পার্ক থার্মাল থেকে দ্রুত বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম ট্রেন স্টেশনে।ওরা দুজন অপেক্ষমাণ কক্ষে বসে আছে। ওদের সাথে দেখা করেই চলে গেলাম ষ্টেশনের টিকেট কাউন্টারে।স্টেশনে যাত্রীর হুড়োহুড়ি নেই। কাউন্টারের কর্তাব্যক্তি বেশ আয়েশী সময় পার করছে।ভদ্রলোক জানালো শামনি যাওয়ার পরবর্তী ট্রেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর।কি আর করার,টিকিট কেটে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।কিন্তু, এতো সময় ষ্টেশনে বসে থাকা আমার জন্য অস্বস্তিকর তাই ওদেরকে বসিয়ে রেখে আমি আবার বেরিয়ে পরলাম, আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। কুয়াশাহীন রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া কারণে চারপাশের পাহাড়ের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে।কুয়াশার কারণে অন্য সময় দূর পাহাড়ের দৃশ্য এতো স্পষ্ট সাধারণত দেখা যায় না।


ঘোরাঘুরি করে ট্রেন ছাড়ার পনেরো মিনিট পূর্বে ষ্টেশনে চলে এলাম। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো।তাই পাঁচ মিনিট সময় হাতে রেখে আমরা ট্রেনে প্রবেশ করলাম। লোকাল ট্রেন কিন্তু ভেতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।টয়লেট,মোবাইল চার্জ দেবার ব্যবস্থা সহ সব ধরণের যাত্রী সুবিধা রয়েছে ভেতরে। আমাদের পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথ।মাঝে দশটি স্টেশনে স্বল্প সময়ের বিরতি নিয়ে ট্রেন পৌঁছুবে শামনি মোঁ ব্ল স্টেশনে।দিনের মধ্যভাগেের নির্ধারিত সময়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করলো।কিছু দূর এগুনোর পর থেকে শুরু হল বিস্ময়।ট্রেন যতই পথ পাড়ি দিতে লাগলো আমাদের বিস্ময় ততই বাড়তে লাগলো। 


রেলপথের দুপাশেই  পাহাড়ি  প্রকৃতি।পাহাড়ের পাদদেশের সমভূমিতে গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো সাজানো গোছানো গ্রাম। গ্রামগুলো সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ।সুশৃঙ্খলিত গ্রামগুলোর ছোট্ট বাড়ীগুলো দৃষ্টিনন্দন ও বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতায় ভরা ।তুষারের শুভ্রতায় স্বর্গীয় এক আবহ তৈরি হয়ে আছে। দূর থেকে মনে হচ্ছিলো, গ্রামগুলোকে যেন  কোনও এক বিশেষ আনন্দ উৎসবের জন্য সাজানো হয়েছে।  

ভাবছিলাম, Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের আজকের যে সহজ জীবন যাপন ও সৌন্দর্যের যে দৃশ্যপট দৃশ্যমান তা এক দিনে কি তৈরি হয়েছে?  সম্পূর্ণ এক বৈরি প্রকৃতিকে পরিপূর্ণ শাসনের মধ্যে নিয়ে আসতে এখানকার মানুষকে কতই না শ্রম ঘাম ঝরাতে হয়েছে।যেখানে ফসল উৎপাদনের আবাদযোগ্য একখণ্ড কৃষি জমি নেই,  সেই অবাসযোগ্য অঞ্চল আজ হয়ে উঠেছে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল।নাগরিক জীবনের সমস্ত সুবিধা আজ স্থানীয়দের হাতের নাগালে।  

কোথাও নিম্নাঞ্চলের সড়কের সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার সংযোগের জন্য সুউচ্চ পিলার দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাই ওভার ব্রিজ।আবার কোথাও পাহাড়ের শরীর কেটে সুরঙ্গ তৈরি করে করা হয়েছে রেলপথ।

রেলপথের দুইধারের কোল ঘেঁষে কোথাও পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় দৃশ্য, পথের দুই ধারে মাঝে মাঝে  সাড়ি সাড়ি ঘন গাছের ছোট ছোট বন।এক পাশ দিয়ে ছোট্ট নদীর বুকে বয়ে চলছে বরফ শীতল জলের ধারা। নদীর দুই ধারের তুষারের আবৃত ঘন জংলা গাছগাছালির নদীর জল ছুঁয়ে চুপচাপ স্থির হয়ে থাকার দৃশ্য যেন ক্যানভাসের ছবির মত ।

আমরা যখন ট্রেনের মধ্যে ছিলাম তখন আমি আর মিশেল দুজনেই ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণে এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম যে,মনে হচ্ছিলো একটু বেখেয়াল হলেই কোন নতুন সৌন্দর্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবো। 

আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো, আজ আমার পৃথিবীতে আসা সার্থক। স্রষ্টার উপহার দু চোখকে যদি এমন সৌন্দর্যের স্বাদ আস্বাদন না করিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতাম তাহলে বড় এক অপূর্ণতা থেকে যেতো। কল্পকাহিনীর সিনেমাগুলোতে সাধারণত যেমন দৃশ্য অ্যানিমেশন করে দেখান হয়, আমি অনুভব করছিলাম ঠিক সেই দৃশ্যের বাস্তবত ভূমিতে আমরা অবস্থান করছি।আল্পস অঞ্চলের যেসব ছবি ও ভিডিও দেখে একসময় অভিভূত হতাম সেসব ছবির চেয়ে বাস্তব দৃশ্য আমার মনে বেশী মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। 

 

আমরা পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ এই বিশ্বের কোন এক প্রান্তে জন্মগ্রহণ করে ঐ প্রান্ত থেকেই বিদায় নেই।কিন্তু,  আমাদের এই ধরিত্রী যে কত বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে ভরপুর তার কিঞ্চিত অংশও দুচোখ মেলে দেখার সৌভাগ্য হয়না।পৃথিবীর কোথাও সমভূমিতে ফসলী মাঠের বাতাসে নেচে চলা,কোথাও আকাশমুখী পাহাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা,কোথাও বৃক্ষরাজিহীন উত্তপ্ত ধূধূ মরু প্রান্তর,কোথাও আগুনের লাভা উদগীরণকারী আগ্নেয়গিরি,কোথাও সবুজে সবুজময় প্রাণ প্রকৃতিতে ভরপুর বনভূমি,কোথাও অবিরাম ঝরে পড়া স্বচ্ছ জলের ঝর্নাধারা, কোথাও তুষার ধবল বরফে ঢাকা অঞ্চল,আবার কোথাও ধুধু জলরাশির নীলচে সমুদ্র। এই বৈচিত্র্যতার সবকিছু যে মানুষ দেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারলো,আমার মনে সেই মানুষটিই পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান।যে মানুষ সারা জীবন অর্থ উপার্জন করে শুধু ব্যাঙ্কের জমা অর্থের পরিমাণের অংক দেখে জীবন কাঁটালো কিন্তু দুচোখ মেলে পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যতা দেখার সময় বের করতে পারলো না, তার থেকে হতভাগা কেউ হতে পারে বলে আমার মনে হয় না।  


ভূস্বর্গের মধ্যদিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথের ইতি টেনে আমাদের ট্রেন এসে দাঁড়ালো শামনি ষ্টেশনে। ষ্টেশন থেকে কিছু দূর এগুতেই মনে হল,আমরা একটি বিনোদন পার্কে এসেছি পৌঁছেছি।ষ্টেশন সংলগ্ন ছোট্ট শহর, মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। সরু নদীর সামান্য দূরত্বে দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুপারের সংযোগ সৃষ্টিকারী দৃষ্টিনন্দন সেতু।আমরা নদীর দুপারে কিছুটা ঘোরাঘুরি করে মায়াবী শহরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলাম।রেস্তরা, সুভেনিরের দোকান,হোটেল, কাসিনো,নানারকম বিনোদন কেন্দ্র,স্থানীয়দের বাড়িঘর আর পর্যটকদের পদচারনামুখর পাহাড়ের প্রাচীরের ঘেরা শামনি যেন এক ফ্যান্টাসি’র নগরী। 




ঐতিহাসিক ভাবে, শামনি শহরের দখলকৃত অঞ্চলটি বসতি সৃষ্টির পূর্বে জলবায়ু ও ভৌগলিক  অবস্থানের কারণে মূলত অবহৃত ও প্রতিকুল অঞ্চল ছিল।জনবসতিহীন অঞ্চলটি  ১২১ খ্রিষ্ট পূরবের দিকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। 


১৭৪১ সালে ইংরেজ অভিযাত্রী  উইলিয়াম উইন্ডহাম William Wyndham তার বন্ধু Richard Pocock রিচার্ড পোকোক এর সাহায্যে শামনি আসেন।এদের আগমনকে শামনি’র পর্যটনের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।এই অর্থ এই নয়, তাদের পূবে অন্য কেউ বাইরে থেকে এখানে ঘুরতে আসেনি। উইন্ডহাম এই হিমবাহ উপত্যকায় এসে আবিষ্কার করেন একটি দরিদ্র পীড়িত পর্বত আরোহী জনগোষ্ঠী, যাদের প্রধান উপজীব্য পশুপালন ও জব চাষ।এই দুই অভিযাত্রী প্রথম বিশাল মোঁ-ব্লঁ’র (আল্পস) উত্তর মুখে অবস্থিত লা মের দো গ্লাস la Mer de Glace অর্থাৎ বরফের সমুদ্র নামক উপত্যকা পরিদর্শন করেন।উইন্ডহাম ফিরে গিয়ে তার এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেন, যা তখনকার বড় বড় পত্রিকা,ম্যাগাজিন ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সমস্ত ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পরে।যার ফলে, শামনি সম্পর্কে ইউরোপিয়ানদের চরম ভাবে আকৃষ্ট করে তোলে।তাছাড়া,আঠারো শতক এমন একটি সময় যখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এক আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং পাহাড়ের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে।পরবর্তীতে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান অভিজাত শ্রেণী এই অঞ্চলে ভ্রমণ উপলক্ষে আসতে শুরু করে।যা ওই সময়ের অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে ।  

১৯৭০ সালে এখানে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় মাদাম কুতরোঁ (Madame Coutterent) সরাইখানা। 

১৯৮৩ সালে ছুছুর (Saussure),গোত( Goethe),বুররি (Bourrit) মত খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের আগমন এই অঞ্চলকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।

এছাড়া, এই অঞ্চলে এক সময় ক্রিস্টাল শিকারিদের আগমন ঘটে, তারা পাহাড়ের দামি দামি কোয়ার্টজ পাথরের সন্ধান করতো। তাদের কারণেও এই শহর পরিচিত হয়ে ওঠে।এসব ক্রিস্টাল পাথর সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বিক্রি করা হত।সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপের বড় বড় প্রাসাদের সৌন্দর্য বর্ধন কাজে ব্যবহারে জন্য।এটিও এক  সময় এখানকার বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে।


পর্যটন ব্যস্ততা বাড়ার ফলে ১৮১৬ সালে এখানে প্রথম স্থাপিত হয় বিলাসবহুল হোটেল « Hôtel de lUnion »।পরবর্তীতে La Couronne, le Royal এর মত আরও অনেক হোটেল গড়ে ওঠে। 


১৮৬০ সালে শামনি ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির জন্য পাহাড়ি গ্রাম ছালানস sallanches এর ভেতর দিয়ে নির্মাণ করা হয় সড়ক পথ ।  


এভাবেই অতি সাধারণ ছোট্ট শামনি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম এক পর্যটন স্থানে। 

উনিশ শতক অবধি শামনি’র প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি ছিল এখানকার পর্যটক গাইড বা প্রদর্শকেরা কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে এই ক্ষমতা দখলে নেয় হোটেল মালিকেরা।   


 

আমরা একটি স্যান্ডুইচের দোকানে ঢুকে দ্রুত মধ্যাহ্ন ভোজের পর্ব শেষ করে শহরের ভেতরটা আরও একটু ঘুরে দেখলাম।মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলার সঙ্গে পাহাড়ের রূপ পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।পাহাড়ের একই চূড়া কিছুক্ষণে ব্যবধানে নানা রঙ রূপে ধরা দিলো আমার ক্যামেরার ফ্রেমে। 


শহরের এককোনে ক্যাবল কার ছুটে চলছে আকাশ চুম্বী পাহাড় চূড়ার দিকে।আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে দুঃসাহসী একদল সৌখিন প্যারাস্যুট আরোহীর দল।স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্যাবল কারের দিকে যাওয়ার রাস্তা জেনে আমরা ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম। আমাদেরকে বেশ কিছু সময়ের পথ হেঁটে স্টেশনে এসে পৌঁছুতে হল।দূর থেকে ক্যাবল কার স্টেশনটি কাছে মনে হলেও ততটা কাছে নয়।এটি লো ব্রেভো টেলেফেরিক (Le Brévent Téléphérique) স্টেশন। টিকেট কাউন্টারের কর্মরত ব্যক্তিকে পরবর্তী যাত্রার সময় জানতে চাইলে সে বলল, আর মাত্র দুবার পাহাড় চূড়ার দিকে যাত্রা করে ক্যাবল কার দিনের কার্যক্রম শেষ করবে।আমরা টিকেট সংগ্রহ করে দ্রুত স্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা ক্যাবল কারের মধ্যে অবস্থান নিলাম।এখানেও ক্যাবল কারের টিকেটের দাম বেশ চড়া।এই যানে করে পাহাড় চূড়ায় ওঠার জন্য আমাদের দুজনকে ব্যয় করতে হল প্রত্যেকের ৩৭ ইউরো করে ৭৪ ইউরো এবং মিশেলের জন্য ৩১ ইউরো।তবে পাহাড়ের চূড়া থেকে কিছুক্ষণের জন্য ভিন্ন রূপে পৃথিবী দেখার নেশা পর্যটকদের এই অর্থ ব্যয়ের চিন্তাকে ভুলিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাবল কার আমাদেরকে শামনির লো ব্রেভো (Le Brévent) চূড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য যাত্রা শুরু করলো। কার যতই উপড়ে উঠতে লাগলো দৃষ্টিতে শামনি শহর ততই ছোটো হয়ে এলো।ভূমি থেকে ২৫২৫ মিটার উচ্চতায় পৌঁছানোর পর উড়ন্ত পাখীর দৃষ্টির মত এক পলকেই পুরো শহরের দৃশ্য চোখে ধরা দিলো।দুই পাহাড়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক মনোরম উপত্যকা শহর।উপর থেকে শামনির বাড়ীঘর ও স্থাপনাগুলোকে এতোই ছোটো মনে হচ্ছিলো যে,এক একটি ইটের খণ্ড ভূমির উপর নান্দনিক ভাবে বিছিয়ে প্রদর্শন করা হয়েছে।


লো ব্রেভো (Le Brévent) চূড়া যেন পর্যটকদের এক আন্তর্জাতিক মিলন স্থল।শামনির অন্যান্য চূড়া থেকে লো ব্রেভো উচ্চতায় ছোটো হলেও এখান থেকে আল্পস পর্বতমালা এবং শামনি শহর সহ এর চারপাশ বিস্তৃত ভাবে দেখার জন্য এই চূড়াটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।খুব ছোট্ট একটুকরো উঠানের মত ঢালুভূমি। তার উপর কেউ স্কি খেলছে,কেউবা অবাক বিস্ময়ে সুদূরের বিশাল তরঙ্গের মত বয়ে চলা আদিগন্ত আল্পসের চূড়া দেখছে।পাহাড়ের উপর থেকে পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যময় রূপ যে কারো একটু সময়ের জন্য হলেও বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ও সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবনার ফেলে দেবে।ভূমি,আকাশ ও আদিগন্ত পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হবে বিশাল সৃষ্টির মাঝে কতটা ক্ষুদ্র আমাদের অবস্থান।অথচ, এই ক্ষুদ্র মানুষই এই বিশালতাকে চিন্তায় ধারণ করে উন্মোচন করে চলেছে একের পর এক অকল্পনীয় অজানা অধ্যায়ের দুয়ার।


এখানকার পর্বতমালার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ইটালি এবং সুইজারল্যান্ডের আল্পস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এগুই দু মিদি (aiguille de midi) চূড়া হচ্ছে শামনি’র সব চেয়ে উচ্চতম চূড়া। ভূমি থেকে উচ্চতা ৩৮৪৩ মিটার। এই চূড়াকে বলা হয়ে থাকে আল্পস পর্বতমালার হৃদয়।মনে হচ্ছিলো, আল্পসের হৃদয়ের উপরে গিয়ে যদি দাঁড়াতে পারতাম তবে তবে হৃদয় পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত হত।যাহোক,কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে লো ব্রেভো’র পৃষ্ঠে  আমরা স্বাধীন ভাবে যার যার কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।নিরাপত্তা জালের বেষ্টনী দেয়া পাহাড় চূড়ার এক কোনে বসে সুমি পর্বতমালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। মিশেল নিজের ক্যামেরা নিয়ে ওর মত ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে লাগলো।আমি ছবি তুলছি আর মাঝে মাঝে মিশেলকে লক্ষ্য রাখছি দৃষ্টির মধ্যে রাখতে।কিন্তু,চোখের একটু আড়াল হতেই ও মুহূর্তেই স্থান পরিবর্তন করে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে ও লো ব্রেভো’র ছোট চূড়াটি নিজের আয়ত্তে মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। যদিও চূড়ার বিপদজনক স্থানগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া থাকলেও বিপদে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে।তাই,ওর দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে আমার ছবি তোলায় মন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল বারবার।হঠাৎ চোখ আটকে গেল দারুণ এক মনোরম দৃশ্যে।এক তরুণ তরুণী যুগল চূড়ার এক পাড়ে বসে সেলফি স্ট্যান্ডের সাহায্যে খুব নিবিড় ভাবে নিজেদের ছবি তুলছে। ওদের একে অপরকে জড়াজড়ি করে বসে থাকার অঙ্গ ভঙ্গি,ভাব বিনিময়,ছবি তোলার দৃশ্য দেখে আমার কিছুটা কৌতূহল হচ্ছিলো।ওদেরকে অন্য সাধারণ যুগলদের থেকে একটু ভিন্ন মনে হতে লাগলো।সুমি আমার কাছে আসতেই ওদেরকে দেখালাম।দুজন বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর নিশ্চিত হলাম ওরা বাকপ্রতিবন্ধি দম্পতি। ওদের দুজনের মুখে ভাব বিনিময়ের ভাষা না থাকলেও দুজন দুজনের প্রতি আবেগের যে উচ্ছ্বাস ও আকুলিবিকুলি ভাব ফুটে উঠেছে তা দেখে মনে হয়েছে, অন্তরে যদি একে ওপরের প্রতি নিখাত ভালোবাসার অনভুতি থাকে তবে ভাব বিনিময়ের জন্য কণ্ঠ না থাকলেও কোন ক্ষতি নেই।শরীরের ভাষা দিয়েও একে অপরকে বুঝে নেয়া যায়।


দিনের আলো প্রায় শেষের দিকে।পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক ঘণ্টা পর ক্যাবল কার শেষবারের মত সমস্ত দর্শনার্থীদের নিয়ে পাহাড়চূড়া থেকে ভূমির উদ্দেশ্যে রওনা করবে।শেষ সময়টুকু একসাথে কাটাবার জন্য আমরা তিনজন চূড়া থেকে খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম।দারুণ একটা কাঠের পাটাতনের ছাউনি বিহীন তেরাস বা বারান্দা সম্বলিত রেস্তরাঁ।বারান্দা নিরাপত্তার জন্য কাঁচের বেষ্টনী দেয়াল দিয়ে ঘেরা।আমরা দুটি কফির অর্ডার দিয়ে তেরাজের একটি টেবিলে বসলাম।বেলা শেষের সূর্যের সোনালি আলোর আভায় দূরপাহাড়ের চূড়াগুলো তামাটে রঙ ধারণ করেছে।সুদূরে উপত্যকার মাঝ দিয়ে সূর্য ধীরে ধীরে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছে।সমুদ্রের পাড়ের সূর্যাস্ত যেমন মনোহর,তেমনি পাহাড় চূড়ার সূর্যাস্তের দৃশ্যও কম  মনোমুগ্ধকর নয়।দিন শেষের মনোলোভা এমন ক্ষণে ২৫২৫  মিটার উপরের হিমশীতল বাতাসের মধ্যে বসে কফির কাপের চুমুক বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিলো জীবনের অন্যরকম এক সেরা মুহূর্ত পার করছি আমরা। লো ব্রেভোতে (Le Brévent) অনেকটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।আমাদের মত কিছু পর্যটক সমস্ত কার্যক্রম শেষ করে ভূমিতে পদার্পণের জন্য ক্যাবল কারের অপেক্ষায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে অলস সময় পার করছে।


আল্পসের চূড়া থেকে ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা ক্যাবল কারে গিয়ে বসলাম। সুদূরের বরফের প্রলেপ মাখা পাহাড়ের গা জুড়ে ধূসর বিস্তীর্ণ পাইনের বন যেন তৃণভূমি সদৃশ। যখন আমাদের কার গাছগুলোর মাথার উপর দিয়ে ধীরে নামতে শুরু করলো তখন বোঝা গেলো, গাছগুলো কত লম্বা ও পুরনো।কার যতই নিচে নামতে লাগলো শামনি শহর ততই আমাদের চোখে বড় হতে লাগলো।পাহাড় চূড়া থেকে নামার সময় চারপাশের পাহাড়ের দৃশ্য ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দিচ্ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে চূড়ার উন্মুক্ত আকাশের নিচ থেকে নেমে আমরা আবার অবস্থান নিলাম পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা শামনি শহরে।ক্যাবল কার ষ্টেশন থেকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম ট্রেন ষ্টেশনে।ট্রেনের শেষ যাত্রার সময় জেনে রাতের শামনি উপভোগের জন্য হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম।।রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পাহাড়ের অবয়ব অনেকটাই ঝাপসা হয়ে এলো, কিন্তু খ্রিস্মাস উপলক্ষে শহরের আলোকসজ্জার রঙ্গিন বাতিগুলো জ্বলে ওঠায় সামনি শহর রূপ নিলো নতুন আঙ্গিকে।


আমি কোথাও ঘুরতে গেলে মনে হয়, আর কখনো এই স্থানে আসা হবে কিনা তা অনিশ্চিত।তাছাড়া নতুন স্থানের বাড়িঘর দোকানপাট, মানুষের জীবনযাপন আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। তাই ঐ স্থানের আকর্ষণীয় দৃশ্যপট ক্যামেরায় ধরে রাখার প্রতি আমার দারুণ এক নেশা রয়েছে।যার ফলে আমার সাথে মিশেল ও ওর মা  ঘুরতে বের হলে ওরা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা।মিশেল ফরাসি ভাষায় একটি কথা বলে Profite du temps »প্রফিতে দু ত »অর্থাৎ সময়কে উপভোগ কর, ওর  মত হচ্ছে,ঘুরতে বেরিয়ে সময়টাকে দেখে ও গল্প করে উপভোগ করতে হবে,অন্যদিকে মনোযোগ দিলে একসাথে ঘুরতে বেরনোর অর্থ হয়না।এজন্য আমার ছবি তোলা নিয়ে ও আমাকে অনেক সময় ব্যঙ্গ করে।যে কোন একটা কিছু দেখিয়ে বলবে,বাবা এটার ছবি তোল,ওটার ছবি তোল।ওর রসাত্মক ব্যঙ্গ  আমি বেশ উপভোগ করি।ওর কথার যুক্তি থাকলেও নেশার কারণে আমি এই অভ্যাস থেকে বেরুতে পারিনা।এবারও তাই হল,আলো ঝলমল বরফে ঢাকা রাতের শামনি’র মাঝদিয়ে বয়ে চলা সরু নদীর রঙ্গিন জলের ধারা,নতুন রূপে উদ্ভাসিত নদীর দু পাশের দালানকোঠার দৃশ্য,রাস্তায় পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য পথশিল্পীদের নৃত্য ইত্যাদি আমাকে বারবার ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন করছিল।অবশেষে ওদেরকে বলে আমার মত করে একটু আলাদা হয়ে ছবি তোলায় মনোনিবেশ করলাম।ওরা মা মেয়ে ওদের মত করে ঘোরাফেরা ও কিছু কেনাকাটা করে সময় কাটালো। 

স্বপ্নের শামনিতে বাস্তব পদচারনামুখর একটি আনন্দঘন দিনের ইতি টানিয়ে আমরা আবার ছা জারভে লে বাঁ লো ফায়ে’র উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠলাম।ফেরার পথে এবার আর চারপাশের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যগুলো চোখে ধরা দিলনা। রাতের আবছায়ায় নিস্তব্ধ পাহাড়ি উপত্যকা পথ পেরিয়ে চলে এলাম আমাদের ক্ষনিকের নীড়ে। 

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-১)
বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-২ , মোঁ ব্লঁ)


মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)

পারিস ,ফ্রান্স ।