ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে বাস স্টেশনে একটি বাস যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ।চালককে বললাম,আমি প্যারিস থেকে কয়েকদিনের জন্য এই অঞ্চলে ঘুরতে এসেছি,দুদিন শামনি শহর ও এর আশেপাশের অঞ্চল ঘুরেছি,এখান থেকে বাস অন্য আর কোন পর্যটন স্থানে যায়, জানাবেন কি? ভদ্রলোক বলল, আমি পাছি প্লেন জু (Passy Plaine-Joux)যাবো,এটি একটি স্কি সেন্টার এবং খুব আকর্ষণীয় স্থান,আমি একটু পরেই রওনা হবো, আপনি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আমি কোন চিন্তা না করে চালকের কাছ থেকে ছয় ইউরোতে একটি টিকেট সংগ্রহ করে বাসের ভেতরে গিয়ে বসলাম।
বাস কিছু সময়ের মধ্যে সমতল উপত্যকা গ্রাম পেরিয়ে প্রবেশ করলো পাহাড়ি পথে।পাহাড়ের কোল ঘেঁষা পথ একে বেঁকে উপড়ে উঠে গেছে।পথের মাঝে মাঝেই ভয়ঙ্কর বাক। চালক খুব সতর্কতার সঙ্গে সেগুলো পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।মোটরযান চালনায় বিশেষ দক্ষতা না থাকলে এই পথে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক।রাস্তার কোথাও কোথাও ভয়ঙ্কর পাহাড়ি ঢালু কিন্তু তেমন কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী বেড়া নেই।বাস যতই উপড়ে উঠছিল দূরের পাহাড়ি গ্রাম ও বিস্তীর্ণ উপত্যকা ভূমি ছবির দৃশ্যের মত ধরা দিচ্ছিল দৃষ্টিতে।এই খাড়া পাহাড়ি পথের পাশদিয়ে কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে ছোট ছোট আবাসিক এলাকা, দোকানপাট, বিনোদন কেন্দ্র, হোটেল, রেস্তরাঁ।রাস্তার দুধারে ঘন পাইনের বন।সুশীতল বরফের ছায়াঢাকা পথ।বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে চলার পথের সময়টা উপভোগ করছিলাম আর ওদেরকে মনে পড়ছিল।প্রায় চল্লিশ মিনিটের পাহাড়ি এক দুর্গম খাড়া পথ বেয়ে বাস তার গতি থামাল পাছি প্লেন জু স্টেশনে। আমি বাস থেকে নেমেই আশেপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করে নিলাম।
উপত্যকা ভূমি থেকে ১৩৬০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ছোট্ট একটি স্কি ষ্টেশন।পর্যটক ও স্কিয়ারদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি দারুণ স্থান।রেস্তরাঁ,পর্যটন তথ্য কেন্দ্র,জাদুঘর,স্কি শেখার স্কুল এবং স্কি ভাড়া ও বিক্রয় সামগ্রীর দোকান সবই রয়েছে।স্থানটির একপাশে ৩৮২ মিটার উচ্চতার পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা এবং চূড়া ধূসর মেঘের সঙ্গে জড়াজড়ি করছিল। অন্য পাশে উন্মুক্ত আকাশের নিচে উপত্যকা ভূমি আর আদিগন্ত পর্বতমালা। মেঘ আর রৌদ্রের লুকোচুরি খেলায় প্রতিনিয়ত অদ্ভুতভাবে পর্বতচূড়াগুলোর রূপ পরিবর্তন হচ্ছে।আমি বরফের স্তরের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালাম পাহাড়ের পারের উপর।পারের জায়গায় জায়গায় সতর্ক সংকেত দেয়া রয়েছে।পার এতোটাই খাড়া এবং উঁচু যে কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।বিমান থেকে যে ভাবে ভূমি দেখা যায় এখানে দাঁড়িয়ে সামনের দৃশ্যপট সেভাবে ধরা দিলো আমার সামনে।কয়েক দিনের অতি পরিচিত এলাকাকে এক পৃষ্ঠায় অঙ্কিত একটি মানচিত্রের মত লাগছিল। সুউচ্চ স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো ২২৭৫ মিটারের দীর্ঘ সেতুর ভিয়াদুক দে এগ্রাত (Viaduc des Égratz), যেটির উপর দিয়ে আমরা বাসে করে শামনি গিয়েছিলাম সেটি একেবেঁকে চলা একটি চিকন সরীসৃপের মত দেখাচ্ছিল।ক্যামেরার লেন্স জুম করে খুঁজে পেলাম ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে (St-Gervais-les-Bains-le-Fayet)ট্রেন স্টেশন এবং আমাদের ক্ষণিকের আবাস এলাকা। বুঝতে পারলাম আমি কোথায় অবস্থান করছি। কয়েকদিন ছা-জারভে লে বাঁ এলাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি পাহাড়ের বিশালতার দিকে দাঁড়িয়ে মনের ভেতর নানা প্রশ্ন জাগছিল,ঐ উচ্চতায় উপর কি মানুষ যেতে পারে?ঐপাহাড়ের ভাজে কি কোন বসতি আছে? ইত্যাদি। দূর থেকে খাড়া পাহাড়টির অবয়ব দেখলে এতোই দুর্ভেদ্য মনে হয় যে, যে কারো মনে এমন ভাবনার জন্ম দেবে।
পাছি প্লেন জু’র পারে দাঁড়িয়ে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম।দূর থেকে যে পাহাড় দেখে আমার মধ্যে নানা কৌতূহল জন্ম নিয়েছিল আমি বাসে করে সেই পাহাড়ের গা বেয়ে তারই শীর্ষ চূড়ায় এসে পৌঁছেছি।ব্যাপারটা যে এভাবে বাস্তব হবে তা ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম।
পাছি জু’র পারে দাঁড়িয়ে Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কে একটি ধারনা পেলাম।খালি চোখে সমস্ত অঞ্চলকে একটি পেন্সিলে আঁকা ধূসর রঙয়ের স্কেচের মত লাগছিল।ক্যামেরার লেন্স জুম করে ধরার চেষ্টা করছিলাম দূর পাহাড়ি অঞ্চলের জীবন চিত্র। বিস্তীর্ণ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উপত্যকা ভূমি। তার মাঝে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম, আবার কোথাও পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিচ্ছিন্ন মানব বসতি ঘরবাড়ী।
মেসেঞ্জারের ভিডিও কলের মাধ্যমে সুমিকে আমার অবস্থান দেখিয়ে বললাম, দুপুরের খাবার সেরে যদি আসতে পারো তবে আল্পসকে আরও নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবে। চারপাশের দৃশ্য দেখাতেই ও সহজেই রাজী হয়ে গেল। আমি ওদেরকে এখানে আসার বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে আবার আল্পস উপভোগে নিমগ্ন হলাম।
পাছি’র ছোট্ট পর্বত পৃষ্ঠ যেন একটি বিনোদন কেন্দ্র।খ্রিস্টমাস উপলক্ষে নানা আয়োজনে মেলার ইমেজ বিরাজ করছিলো।বাচ্চাদের আনন্দ দেবার জন্য অনেকে পের নোয়েল বা স্যান্টাক্লজ সেজে এসেছে, কেউবা ধর্মীয় রূপকথার নানা চরিত্রের পোশাক পরে বা বাচ্চাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।
কুকুরের স্লেজ গাড়ি কিভাবে ছুটে চলতো পাহাড়ি বরফ ঢাকা পথে তা সিনেমার পর্দায় দেখেছি, কিন্তু এবার সেই ঐতিহ্যবাহী স্লেজ গাড়ীর দর্শন মিলল এখানে।শেয়াল সদৃশ এক দল সুদর্শন কুকুর পর্যটকদের পেছনে বসিয়ে টেনে চলছিলো বরফের উপর দিয়ে।
পাহাড়ের নানা রূপ ক্যামেরায় ধারণ করতে করতে ছোট্ট যন্ত্রটি দুর্বল হয়ে পরল তাই ওকে চার্জ দেবার জন্য একটি ক্যাফে বারে ঢুকলাম।কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাফে বারের বৈদ্যুতিক হিটারের উষ্ণতায় শরীরে বেশ চনমনে ভাব ফিরে এলো।ক্যাফের চুমুকে নিজে সতেজ হওয়ার পাশাপাশি ছবি তোলার যন্ত্রটি বৈদ্যুতিক সংযোগে কিছুটা শক্তি সঞ্চার করে নিলো।সুমি ফোনে জানালো, ওরা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে।
বিকেল সাড়ে তিনটের দিকে আমার জন্য একটি পিজার বক্স হাতে করে পাছি পৃষ্টে এসে নামলো। চারপাশের দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই উৎফুল্ল ভাব ফুটে উঠল সুমির মধ্যে।আল্পস ভ্রমণে পাছি দর্শন সুমি ও মিশেলের কাছে বাড়তি পাওয়া। ওদের পরিকল্পনার বাইরে এমন একটি জায়গায় আসতে পেরে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানালো।হাতে সময় কম থাকায় ওরা নেমে পরল পাছি’র সৌন্দর্য উপভোগে আর আমি ক্ষুধা নিবারণের স্বার্থে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পিজা অনেকটা জোর করেই পেটে ঢোকাতে লাগলাম পাছি’র এককোণে পেতে রাখা অবকাশ চেয়ার বসে।
ওরা আসাতে আমার আল্পস ভ্রমণের শেষ সময়টুকু বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল।স্মৃতি ধরে রাখতে নিজেদের একে ওপরের ছবি তুলে কাটল বেশ কিছু সময়।সবাই একসাথে হেঁটে বেড়ালাম পাছি পৃষ্ঠের বরফ ভূমির উপর দিয়ে।
যেহেতু,আমাদের প্যারিস ফেরার ট্রেনের সময় সাতটায় তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কিছুটা সময় হাতে রেখে বিকেল পাঁচটার বাস ধরার প্রস্তুতি নিয়ে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালাম।বাস আসার নির্ধারিত সময় অতিক্রম হলেও স্টপেজে বাসের দেখা মিলল না।প্রায় পনের মিনিট পার হয়ে গেল।কিছুটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে পাছি’র প্রবেশ পথের দিকে বাসের জন্য আমরা অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।ফ্রান্সে পাবলিক যানবাহনগুলো সাধারণত সময় সূচি মেপে চলাচল করে, তবে কোন কারণে ট্রাফিক সমস্যার সৃষ্টি হলে ট্রান্সপোর্টগুলোর সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। বুঝতে পারলাম আমরা তেমনি সমস্যার কবলে পরেছি।প্রতিটি অতিতিক্ত মিনিট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হতে লাগলো।নির্ধারিত সময়ের প্রায় চল্লিশ মিনিট পর পাছি’র প্রবেশদ্বারে বাসের আগমন ঘটল।স্টেশনে যাত্রী তোলার জন্য বাস আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে’র উদ্দেশ্যে রওনা করলো।আমরা অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রওনা করলাম।সময়টা এমন যে পথের মধ্যে কোনও প্রকার ট্রাফিক সমস্যায় সময় ক্ষেপণ হলেই আমাদের ট্রেন মিস হবে। পাহাড়ের ঢালু পথে ঘুরে ঘুরে বাস নামতে লাগলো।বাস নিচ থেকে থেকে যখন উপড়ে উঠছিল তখনকার পাহার দেখার অনুভূতি থেকে নামার অনুভূতি সম্পূর্ণই ভিন্ন লাগছিল। আসার সময় নিশ্চুপ ভাবে সময় কাটলেও যাবার বেলার গল্প গুজব আমাদের আল্পস ভ্রমণের স্মৃতিটাকে রাঙ্গিয়ে তুলল।যা অপরিকল্পিত ভাবে হয়ে গেল।বাস দুই একটি স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলা ছাড়া সময় ক্ষেপণ না করে এগিয়ে যেতে লাগলো।সন্ধ্যার জনমানবহীন পাহাড়ি পথটা এমন, যদি কেউ পথের মধ্যে কোন কারণে শেষ বাস মিস করে তবে তার জন্য মহাবিপদ।গা ঝমঝমে পাহাড়ি সড়কটিতে কোন পথচারী হাঁটার ফুটপাত নেই।এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজের দূরত্বও অনেক।পাহাড়ের কোল ঘেঁষা সড়কটি এতোই খাড়া যে এই পথ ধরে হেঁটে ওঠা এবং নামা দুটোই কষ্টকর এবং বিপদজনক। তাই হয়তো কর্তৃপক্ষ পথচারী চলাচলের ব্যবস্থা রাখেনি।মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে স্থানীয়দের যে দু চারতে বসতি রয়েছে তাদের এক মাত্র চলাচলের মাধ্যম ব্যক্তিগত মটরগাড়ি। পর্যটকরাই মূলত পাছি পৃষ্ঠে ওঠা ও আশেপাশের অন্যান্য পর্যটন স্থানে যাওয়ার জন্য পাবলিক বাস ব্যবহার করে থাকে।দুচার দিন ঘোরার জন্য এমন এলাকা আকর্ষণীয় হলেও যাদের এসব অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে হয় তাদের যে নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সন্ধি করে দৈনন্দিন জীবন কাটাতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও ফ্রান্সের নাগরিক জীবনে আধুনির সুযোগ সুবিধার সবকিছুই প্রত্যন্ত রয়েছে।যা হোক,বাস প্রায় চল্লিশ মিনিটের সতর্ক যাত্রার ইতি টানল ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে স্টেশনে।আমরা প্যারিস ফেরার ট্রেনে উঠতে হাতে ত্রিশ মিনিট পেলাম।বাক্সপ্যাঁটরা গোছানোই রয়েছে।দ্রুত পায়ে হেঁটে বাসায় পৌছুলাম।যার যার ব্যাগ নিজ দায়িত্বে নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমাদের ক্ষণিকের ছোট্ট নীড় থেকে।দরজার পাশের ছোট্ট একটি বাক্স। বাসার চাবিটি বক্সের মধ্যে ফেলে দেয়ার মধ্যদিয়ে শেষ হল আমাদের আল্পসের গায়ে ছুটে চলার দিন কয়েকের গল্প ।
বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-১)
বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-২ , মোঁ ব্লঁ)
মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
পারিস ,ফ্রান্স ।